BMV-50 -LATA MANGESHKAR – The Queen of Melody & The Nightingale of India
একেই হয়তো বলে যোগসূত্র বসন্ত পঞ্চমীর শেষ লগ্নে আমাদের আরাধ্য দেবী মা সরস্বতী তাঁর সঙ্গে সসম্মানে নিয়ে গেলেন মর্ত্যের সুরের সরস্বতীকে – লতা মঙ্গেশকর। কেমন যেন মিল খুঁজে পাওয়া যায় এমন সুরের জাদুকরী ও যাঁর কণ্ঠে যেন সারাটাক্ষণ মা সরস্বতী বিরাজ করেছেন এতকাল।
লতা মঙ্গেশকরের কোথায় জন্ম, পরিবারে কয় ভাইবোন ও মাতাপিতার নাম
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে ২৮শে সেপ্টেম্বর,১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর, মাতা শিবন্তি মঙ্গেশকের ঘরে প্রথম কন্যা সন্তান উনিই। তাঁর পরেই তিন বোন যথাক্রমে আশা, ঊষা,মিনা ও একমাত্র ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
বাবা দিনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন খ্যাতনামা মারাঠি, কঙ্কানি সঙ্গীত শিল্পী ও নাট্যশিল্পী।গোয়ালিয়র ঘরানায় একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। ছোটো থেকেই বাড়িতে ছিল সাংস্কৃতিক জগৎকে নিয়ে তালিম,তাই এই গানের তালিম উনার নিজেরও শুরু হয় মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার কাছে।১৯৪১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর গায়িকা হিসেবে পথ চলা শুরু হয়।১৯৪২ সালে যখন তাঁর মাত্র তেরো বছর বয়স তখনই বাবার মৃত্যু হয়।
লতা মঙ্গেশকরের জন্মের ছয়মাস বয়সেই বাবা বুঝতে পারেন তাঁর সন্তানের আগাম প্রতিভা
বাড়ির বড় মেয়ে , তাই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে খুবই অল্প বয়সে।কথিত আছে মঙ্গেশকর পরিবারে মাত্র ছয় মাস বয়সে লতা তাঁর সঙ্গীত প্রবণতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর বারান্দায় বসে সারেঙ্গী বাজাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁর চোখ পড়ে মেয়ের দিকে, মেয়ে মাটিতে শুয়ে মাটি খাচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে কোলে তুলে নেন আর পাশে রাখা সরেঙ্গীর উপর লতার হাত গিয়ে পড়ে।মেয়ে লতা সারেঙ্গীর তার ও আঙ্গুলের জাদুকরী দেখাতে থাকেন সারেঙ্গির উপর এমনভাবে,তাতে মনে হচ্ছিল যেন কোনো গানের সুরের সৃষ্টি হতে চলেছে মেয়ের হাতে ঐ ছয় মাস বয়সেই।
জন্মের পর মেয়ের নাম ছিল “হেমা” বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ” ভাও বন্ধন” নামে এক নাটকে লতিকা নামক এক চরিত্র দেখে বিশেষ ভাবে অনুপ্রেরণা পান আর সেখান থেকেই মেয়ের নাম রাখেন ” লতা মঙ্গেশকর”।উনাদের এমনিতেও পদবী ছিল হার্দিকার উনি নিজেই পদবী পাল্টান আর নাম রাখেন মঙ্গেশকর।যদিও এর কোনো অন্য কারণ আছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষ জানা নেই।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই শুরু হয় গানের তালিম, বাবার বিশেষ ইচ্ছে ছিলো মেয়ে ধ্রুপদী গান নিয়েই থাকুক আজীবন।খুব কম লোকই হয়তো জানেন লতা মঙ্গেশকর যখন প্রথম প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেন তখন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয় তাঁর কণ্ঠস্বর খুব পাতলা এই বলে।
লতা মঙ্গেশকরের প্রথম গাওয়া গান কেন মুক্তি পায়নি
লতার গাওয়া প্রথম গান কোনোদিনও মুক্তি পায়নি এই গানের নাম ছিল ” নাচু ইয়া গাদে,খেলু শাড়ি মনি হাউস ভরি” গানটি ১৯৪২ সালে ” কিটি হোস্টেল” নামক মারাঠি চলচ্চিত্রের জন্য সদশিবকর নভেদকর দ্বারা রচিত হয়। গানটি লতার কণ্ঠে ডাব করা হলেও ছবির ফাইনাল কাটে বাদ পড়ে যায়।সেই কারণেই গানটি আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এরপরেই লতা মঙ্গেশকর দ্বারা প্রকাশিত গান ছিল “নাটালি চৈত্রাচি নাভাইল” যার সুর দিয়েছিলেন দাদা চান্দেনকার।এই গানটি ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি “পাহেলি মঙ্গলা- গৌর “এ প্রকাশ পায় যেখানে উনি নিজেও একটা ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করেন।১৯৪৬ সালে প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক হিসেবে তাঁর গান প্রকাশ পায় ” পা লাগুন কর জোরি” এই গানটি ,চলচ্চিত্রের নাম ছিল ” আপকা সেবা”।এই গানের পরেই সুরকার গুলাম হায়দার তাঁকে প্রথম বড় সুযোগ দেন “মজবুর” চলচ্চিত্রে “দিল মেরা তোরা” ।ঠিক এই গানের পর থেকেই উনাকে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি।
লতা মঙ্গেশকরের এযাবৎ কতগুলো ভাষায় গান, ও গানের সংখ্যা, রয়ালিটি নিয়ে ঠিক কি বিবাদ, বোন আশার সাথে বিবাদের কারণ
৩৬ টি প্রাদেশিক ভাষায় উনি গান গেয়েছেন ও প্রায় তিরিশ হাজারের ও বেশি তাঁর গান আছে এযাবৎ।ভারতীয় সঙ্গীতে আরেক কিংবদন্তি শিল্পী মহম্মদ রফির সাথে প্রায় তিন বছর উনি কোনো গান করেননি।কোনো এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেন বিবাদের মূল কারণ ছিল গানের রয়ালটি নিয়ে।১৯৬০ এর দশকে শিল্পীদের একটা সমিতি ছিল।মুকেশ, তালাত মেহমুদ তখন একটি দাবি তুলেছিলেন শিল্পীদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মানী বুঝিয়ে দিতে হবে।
যদিও লতা মঙ্গেশকর তখন রয়ালটি পেতেন,তাই তিনি এটি সমর্থন করতেন,মহম্মদ রফি এ দাবির বিরোধিতা করেন।লতা মঙ্গেশকর বলেন পরবর্তী সময়ে রফি নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও লেখেন, এর পর শংকর জয়কিষানের সুরে তারা দুজনে গানও করেন।রফি পুত্র শহীদ রফি প্রতিবাদ করেন এই বিষয়ে যে তাঁর বাবা কখনোই লতাজিকে এমন চিঠি দেননি।
বোন আশা ভোঁসলের সাথে বিবাদের কারণ ছিল ,আসা ভোঁসলের প্রথম স্বামী গণপত রাও কে নিয়ে।উনি বলেছিলেন লতার জন্যই নাকি তাঁর স্ত্রী আশা ভোঁসলে কোনো গান পান না, যেহেতু লতা মঙ্গেশকর তখন খ্যাতির শীর্ষে।বিবাদ এতটাই ঘোরতর হয় যে পরের দিকে গণপত রাও আশাকে লতার বাড়ি পর্যন্ত যেতে দিতেন না,এমনকি দুই বোনের দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। আশা ভোঁসলের দ্বিতীয় স্বামী রাহুল দেব বর্মনের জন্যই নাকি দুই বোনের আবারও মিল হয়।
শচীন দেব বর্মনের সাথে লতা মঙ্গেশকরের বিবাদ
শচীন দেব লতা মঙ্গেশকরের গান সম্পর্কে খুবই বিশ্বাস করতেন, উনি বারেবারে একটাই কথা বলতেন “এই মাইয়াটা আমায় যাদু করসে, ওরে ছাড়া আঁধার দেহি আমি”।সেই সময় লতার খ্যাতি ও সুনাম চরম শীর্ষে।একটা গানের সুর দিচ্ছেন শচীন কর্তা সেখানে লতাজির কোনো কথা চলবে না,তবে একটা ভুল করে বসলেন উনি নিজেও।
শচীন কর্তার সাথে একপ্রকার জেদ ধরে বসলেন, সেটা হলো গানের নোটেশন দেওয়ার জায়গায় কোথাও কোথাও গানের স্বার্থে উনি সেটা বদলে দিতে চান,ঠিক এই জায়গায় শচীন কর্তার নিজের বিশেষ আপত্তি।সেই আপত্তি এতটাই ঘোরতর হয় সেটা মনোমালিন্যের জায়গা নেয় ও উনি অপমানিত বোধ করেন।তাই সঙ্গে সঙ্গে শচীন কর্তা লতাজিকে বাদ দিয়ে বোন আশা ভোঁসলেকে দিয়ে পরবর্তী সমস্ত গান গাওয়ান।সেই সময় শচীন দেবের মত অনেকেই লতাজিকে দিয়ে গান গাওয়ানো বন্ধ করে দেন।
ও পি নায়্যায়ের ছবিতে লতা মঙ্গেশকর কেন কোনোদিন কাজ পাননি
এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে নায়ার সাহেব বলেন লতাজি খুবই উঁচু মাপের শিল্পী এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে উনার গানের গলা তাঁকে কখনোই বিশেষ একটা আকর্ষণ করেনি।তাঁর বরাবর মনে হয়েছে উনার গলা ঠিক রোমান্টিক নয়,এবং ভীষণই পাতলা ,তাঁর মনে হয়েছে গীতা দত্তের গলায় যেমন গুরুগম্ভীর ভাব রয়েছে ঠিক তেমনটি উনি পাননি। তবে গজলের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি গলা তাই পণ্ডিত মদনমোহন পুরোপুরি তাঁর গলা ব্যবহার করেছেন গজলের ক্ষেত্রে।
এক সুপ্ত বাসনা যা এজন্মে পুর্নতা পাওয়ার নয় – লতাজি বলেছিলেন গুলজার সাহেবকে
১৯৬৩ সালে “বন্দিনী” ছবিতে প্রথমবার একসাথে কাজ করেন গুলজার সাহেব লতাজির সাথে।গীতিকার হিসেবে এই প্রথম কেরিয়ার শুরু করেন গুলজার।গুলজার পরিচালিত “কিনারা” ছবির গান “নাম গুম জায়েগা” লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান। গুলজারের সাথে লতাজির সখ্যতা শুরু হয় ঠিক এর পরেই।এক একান্ত ব্যক্তিগত আলোচনায় লতাজি বলেন মনের এক সুপ্ত বাসনা যা কোনোদিনই পূর্ণতা পাওয়ার নয়।সেটা হলো দিলীপকুমার কে উনি প্রিয় নায়কের জায়গায় স্থান দেন অথচ নিজে মেয়ে হওয়ার কারণে ওনার জন্য কোনোদিন প্লেব্যাক গান গাইতে পারবেন না, এটাই সারাজীবনের আক্ষেপ।
লতা মঙ্গেশকর কেন বিয়ে করলেন না, সারাটা জীবন একই ভাবে কাটিয়ে দিলেন
২০১১ সালে নিজেরই জন্মদিনে কোনো এক সাংবাদিক এই প্রশ্ন করে বসেন কেনো তিনি বিয়ে না করেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। এ প্রশ্নের অবশ্য মুখও খুললেন তিনি, তিনি বলেন – “সব কিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছে অনুযায়ী হয়, জীবনে যা ঘটে তা ভালোর জন্যই ঘটে, যা ঘটেনা তাও ভালোর জন্যই ঘটে” তিনি আরো বলেন এই প্রশ্নটা যদি আমাকে চার পাঁচ দশক আগে জিজ্ঞাসা করতেন তাহলে হয়তো উত্তরটা অন্য রকমের হতো”।
রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর ছিলেন লতা মঙ্গেশকরের বাল্যকালের খুবই ভালো বন্ধু।ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস জানিয়েছেন তাঁরা দুজনেই দুজনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু রাজ সিং এর বাবা মহারাওয়াল লক্ষণ সিংজি এই বিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।যদিও লতা মঙ্গেশকর কখনোই এই কারণ সুনিশ্চিত করেননি। তবে বাড়ির দায়িত্বকেই কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন।কারণ বড় বোন হওয়ার সুবাদে মাত্র তেরো বছর বয়সেই যখন বাবা মারা যান তখন থেকেই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পরে তাঁরই উপর।
দিলীপ কুমারের সাথে এত ভালো ভাইবোনের সম্পর্কের মাঝেও কেন লতা মঙ্গেশকরের সাথে সম্পর্কের চির ধরে
দিলীপ কুমার ও লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক একেবারে ভাই বোনের মত।প্রতিবার রাখীর সময়ে দিলীপকুমার কে উনি রাখি পড়াতেন। তাও সম্পর্কের চির ধরে সেটা বহুকাল ,জীবনের প্রায় তেরটা বছর।
সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত ছবি ” মুসাফির” এই ছবিতে একটি গান ” লাঘি না ছোট” গানটি গাওয়ার জন্য দিলীপ কুমারকে নেওয়া হয়েছিল।লতা মঙ্গেশকর জানতেন না এই গানটি উনাকে দিলীপ কুমারের সাথে গাইতে হবে।আর এখান থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত।
দিলীপ কুমার খুব ভালো উর্দু জানতেন আর এই গানেরই অনেক জায়গায় উর্দুর ছোঁয়া আছে তাতে উচ্চারণ পরিষ্কার হওয়ার প্রয়োজন আছে। দিলীপ কুমার লতা সম্পর্কে বলেন মহারাষ্ট্রের মানুষ উর্দু উচ্চারণ ঠিক করতে পারবেন না তাই লতাকে এই গানে না নেওয়াই ভালো।ব্যস এখানেই শুরু হয় বিবাদের যা চলে টানা তেরটা বছর।
লতা মঙ্গেশকরের বেশ কিছু অজানা কাহিনী ও জীবন সম্পর্কে অজানা তথ্য
সর্ষের মধ্যেই ভূত- এক অকল্পনীয় ঘটনা
সালটা ১৯৬২ ,লতা মঙ্গেশকর হেমন্ত মুখার্জীর গানের এক নির্দেশনায় গান গাইতে যাওয়ার কথা ছবির নাম ” বিস সাল বাদ”। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই শরীর বিশেষ ভালো নয়, পেটের অবস্থাও সঙ্গীন, একটু বেলা হতেই শুরু হয় বমি, কিন্তু বমি যেটা করেন সেটা কেমন যেন বেশির ভাগটাই একটা সবুজাভ ছাপ।যথারীতি ডাক্তারও এলেন সমস্ত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার নিজেও মৌন।
একি !এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে বাড়িতে। তাঁকে খাবারের সাথে হাল্কা বিষ মেশানো হয়েছিল।বাড়ির হেড কুক ডাক্তার আসার আগেই ততক্ষণে পালিয়েছেন।অনেক তল্লাশি করেও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। পরে ঊষা মঙ্গেশকর দায়িত্ব নেন হেঁসেলের। সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি সুস্থ হতে উনার সময় লাগে প্রায় মাস তিনেক।এরপরেই সেই কিংবদন্তি গানের সূত্রপাত হয় যা আমাদের সকলের জানা ” কহি দ্বীপ জ্বলে কহি দিল”।
এই ঘটনার সম্পূর্ণ তথ্য সঙ্গীতকার সি রামচন্দ্রন তার নিজের লেখা একটি বইতে প্রকাশ করেন কারণ সমস্ত ঘটনার সাক্ষী ছিলেন উনি নিজেই।
শিল্পীর কোনো দেশ হয়না,ইচ্ছেই যেখানে প্রবল -কোনো বর্ডারই একজন শিল্পীকে আলাদা করতে পারে না
লতা মঙ্গেশকর গেছেন অমৃতসরে এক ছবির গানের প্রমোশনের জন্য সঙ্গীতকার সি রামচন্দ্রনের সাথে, ছবির নাম ” ঝঞ্ঝর” গান
” বাতো হি বাতো মে,” ।সব শেষে মনের ঐকান্তিক ইচ্ছে বর্ডারের ওপারেই লাহোর শহর আর সেখানেই থাকেন বান্ধবী ও সঙ্গীতশিল্পী নূরজাহান একবার কথা বলবেন।সি রামচন্দ্রন ট্রাংক কল বুক করেন ও লতা মঙ্গেশকর ও নূরজাহানের সাথে কথা চলে আনুমানিক এক ঘন্টা।
এখানেই মনের আকাঙ্খিত স্বাদ মেটেনি তাই আবারও জেদ ধরলেন পাকিস্তান যাবেন দেখা করতে নূরজাহানের সাথে কিন্তু সেটা প্রায় অসম্ভব।তার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসার প্রয়োজন। কিন্তু তাতেও যখন উনি থামলেন না সি রামচন্দ্রন শরণাপন্ন হলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।উনার তত্বাবধানে দুই দেশের হাই কমিশনের সাথে যোগাযোগ করা হয় তবে যাওয়ার ব্যাপারে উভয় পক্ষ থেকে নেতিবাচক সাড়া মেলে।
জেদী লতা মঙ্গেশকর দেখা করবেনই, ফিরে আসবেন না দেখা না করে। এরপর উভয় রাষ্ট্র ঠিক করেন একটা উপায় আছে দেখা করার সেটা দুই দেশের মধ্যবর্তী স্থল যাকে No Man’s Land বলা হয় একমাত্র সেখানেই সম্ভব।(প্রসঙ্গত বলার প্রয়োজন আছে যেকোনো দেশের বর্ডারের সাথেই এই জমি থাকে ।উভয়পক্ষেরই সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোনো দেশেরই সেই জমির উপর অধিকার থাকে না।বলা যেতে পারে সেটা কমন অঞ্চল বা জমি তাই একে No Man’s Land বলা হয়)।
যথারীতি দুজনেই তাঁরা আসেন সেই জায়গায় আর কাছাকাছি আসতেই দুজনেই দৌড়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন, আর সমানেই দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে থাকেন। এমন ঘটনার সাক্ষী ছিলেন দুই দেশের বর্ডারে প্রহরারত সেনাবাহিনী , সেই মুহূর্তে তাঁরাও নিজেদের আটকাতে পারেননি।এই ঘটনার সম্পূর্ণ তথ্য সঙ্গীতকার সি রামচন্দ্রন তাঁর নিজের বইতেও লেখেন।
প্রসঙ্গত বলার বিশেষ প্রয়োজন আছে লতা মঙ্গেশকর জীবনে idol বলতে ছোটোর থেকেই গায়িকা নূরজাহান কে মেনে এসেছেন।দেশ ভাগের পর যদিও উনি পাকিস্থানে ফিরে যান কিন্তু সেই সময় “মল্লিকা – ই- তরাইউম” (queen of Melody) এই উপাধি প্রথম ভারতবর্ষ থেকে নূরজাহানই আখ্যা পান। যদিও পরবর্তী সময়ে এই আখ্যা দেওয়া হয় লতা মঙ্গেশকরকে।
“এই মেরে বতন কি লোগো, যরা আঁখ মে ভর লো পানি” গানটির পিছনে কিছু অজানা কাহিনী
দিল্লির রামলীলা ময়দানে প্রথম এই গান করেন লতা মঙ্গেশকর, আর দর্শকাসনে বসেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু।তিনি এতটাই ভাবুক হয়েছিলেন এই গান শুনে নিজের চোখের জল রাখতে পারেননি।
এই গান প্রথমে নাকি আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।এই গানটি ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৬৩ সাল দিল্লির রামলীলা ময়দানে প্রথম গাওয়া হবে। এক দেশভক্তি মূলক গান সেখানে উপস্থিত ছিলেন নওশাদ সাহেব, মদনমোহনজি,শংকর জয়কিশেন ও আরো একজন সি রামচন্দ্রন।গানের গীতিকার শ্রী প্রদীপ মহাশয়ের উপর দায়িত্ব এসে পড়ে গান লেখার।
প্রায় আনুমানিক একশটা গানের অন্তরা লেখেন সেখান থেকে বেছে নেওয়া হয় পাঁচ থেকে ছয় খানি অন্তরা।এই সময় সি রামচন্দ্র ও লতাজির সম্পর্কও বিশেষ ভালো নয়।তাই সি রামচন্দ্র গানটি গাইবার জন্য আশা ভোঁসলেকে অনুরোধ করেন।এদিকে গীতিকার প্রদীপ বাবু লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গানটি গাওয়ার একপ্রকার কথাও দিয়ে ফেলেন।সি রামচন্দ্র ও প্রদীপজির মধ্যে শেষমেশ ঠিক হয় দুজনেই গানটা গাইবেন একই সাথে।
দুই গায়িকা বোন যান সি রামচন্দ্রজির বাড়িতে সেখানে গিয়ে লতা মঙ্গেশকর জানতে পারেন তাঁর সাথে বোন আশাও আছেন এই গানে। লতা মঙ্গেশকর সঙ্গে সঙ্গে বোন আশাকে বলেন “আশা তুই কি পারবি দিল্লি গিয়ে আমার সাথে এই গানটা গাইতে তুই বলছিলিস যে তোর শরীর বিশেষ ভালো নয়?”।
দিদি লতার কাছের থেকে এমন কথা শুনে আশা ভোঁসলে সি রামচন্দ্রকে বাইরে ডাকেন ও বলেন আমার পক্ষেও এই গান করা সম্ভব নয় তাই আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যান।সি রামচন্দ্রজি এই প্রশ্নের সঠিক জবাব আশা ভোঁসলের থেকে না পেয়ে খুবই মর্মাহত হন, যার আসল উত্তর আজীবন অজানা রয়ে গেলো তাঁর কাছে।
কুন্দল লাল সেহগালের সাথে ও লতা মঙ্গেশকের শেষ অসম্পূর্ণ ইচ্ছে …
বাড়িতে লতা মঙ্গেশকরের যদি সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল সেটা সহগালের সিনেমা।তাঁর বাবা মেয়েকে একমাত্র উনারই সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন।বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে লতা সেহগলের গান ও বাবার থেকে শেখা সমস্ত গান ,বাবার ছবির সামনে বসে সারাদিন গাইতে থাকেন।
বাবার মৃত্যুর পর লতা মঙ্গেশকর গান গেয়ে যা পয়সা রোজগার করেন সেই পয়সা দিয়ে একটা মস্ত বড় রেডিও কিনে নিয়ে আসেন একমাত্র ইচ্ছে সেহগলের গান শুনবেন ঐ রেডিওতে।দুপুরে রেডিওটিকে যথাস্থানে রেখে মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন, যেই মুহুর্তে রেডিও চালান ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক করুন সুর ও রেডিওতে এক বার্তা
” সেহগল সাহাব অভি নেহি রহে” ।উনি এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন এই খবরে যে দীর্ঘদিন বাড়ির বারান্দায় পড়েছিল তাঁর সখের রেডিও যেটা তিনি ছুঁয়েও দেখেননি।স্বপ্ন বলতে একটাই ছিল মনের গভীরে জীবনে সাক্ষাতে উনার সাথে একদিন পরিচয় ও আলাপ করতে যাওয়ার।
জীবনে একটার পর একটা ঠিক কি কি হাসিল করেছিলেন ও ব্যক্তিগত শখ
১৯৭৪ সালের সংস্করণ অনুযায়ী গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বাধিক গানের জন্য ওনার নাম তালিকাভুক্ত হয়। পরে লতাজীর বোন আশা ভোঁসলেকে সর্বাধিক গানের রেকর্ড করার তকমা দেওয়া হয়।
১৯৯৯ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা প্রকাশ করলেও অবশেষে তা গ্রাহ্য হয়নি। সাংসদ থাকাকালীন কোনো পারিশ্রমিকও নেননি তিনি।
১৯৬৯ সালে সম্মানিত হন ” পদ্মভূষণ” নামক পুরস্কারে।১৯৮৯ সালে শিল্পী হিসেবে “দাদা সাহেব ফালকে” পুরস্কারে ভূষিত হন।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভারতীয় অসামরিক সম্মাননা পুরস্কার” পদ্মবিভূষণ” পান ১৯৯৯ সালে।
২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ” ভারতরত্ন” পেয়েছেন,এই সম্মানে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় সঙ্গীত শিল্পী।
ব্যক্তিগত শখ বলতে গাড়ির খুবই শৌখিন ছিলেন তাই বেশ কিছু গাড়িও হাসিল করেন। জীবনে প্রথম গাড়ি কেনেন মায়ের নামে ইন্দোর থেকে সেটি ছিল সেভ্রোলে।এছাড়া নিজের বাড়ি “প্রভুকুঞ্জে” রয়েছে বুয়িক, ও ক্রিসলারের মত গাড়ি।যশরাজ ফিল্মের তরফ থেকে “বীরজারা” সিনেমায় অসামান্য গানের জন্য পান মার্সিডিজ বেঞ্জ।
এযাবৎ তাঁর মোট অর্থমূল্য আনুমানিক ৩৭০ কোটি ভারতীয় টাকা।গানের রয়ালটি থেকে মাসিক আয় হতো প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা, আর বার্ষিক আয় ছিল আনুমানিক সাত কোটির কাছাকাছি।জীবনের প্রথম আয় ২৫ টাকা, কিন্তু ৬০এর দশকে উনি প্রতিটি গানের জন্য নিতেন ৫০০ টাকা,বোন আশা ভোঁসলে সেই সময় পেতেন ১৫০ টাকা, তাই কিছুটা হলেও মনোমালিন্য ছিল দুজনের মধ্যে।
সঙ্গীত পরিচালনা করেন নিজের ছদ্ম নাম “আনন্দ ঘন” এই নাম রেখে।একবার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যখন এই নাম বারবার ডাকা হচ্ছিল কেউ পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে উঠে আসছিলেন না, অথচ ঘোষক বারবার বলছিলেন উনি আছেন ঠিক এই দর্শক আসনে। পরে লতা মঙ্গেশকর নিজেই উঠে মঞ্চে যান।
লতা মঙ্গেশকরের পছন্দের খাওয়ার দাওয়ার
সকালে দিন শুরু করতেন ইসৎ উষ্ণ গরম জল খেয়ে। খাবারের পছন্দের তালিকায় ছিল গাজরের হালুয়া, সি – ফুড, স্পাইসি ফুড সেটাও বিশেষ পছন্দ করতেন।আম ছিল অনেকই পছন্দের সেটা যদি আলফানসো আম হয় তাহলে তো কোনো কথায় নেই।
জীবনের শেষ গানটি লতা মঙ্গেশকর ঠিক কোথায় গান
আম্বানি পরিবারের সাথে লতাজির বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল ,তাই তাঁদের যেকোনো অনুষ্ঠানে লতাজি উপস্থিত থাকতেন।আম্বানি পরিবারের মেয়ের বিয়ে ঈশা সেখানে উনি ছিলেন বিশিষ্ট নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন।
সালটা ২০১৮ তখন লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না , তাই ডাক্তারের পরামর্শে কোথাও যাওয়া বারণ ছিল। তখন লতাজী মেয়ে ঈশা ও জামাই আনন্দ পিরামলকে এক শুভেচ্ছা বার্তার চিঠি পাঠান আর নিজের গলায় একটা গান রেকর্ড করে পাঠান।সেই গান হলো গায়ত্রী মন্ত্র। শোনা যায়, আম্বানি পরিবারে এই গানটি অর্থাৎ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে গায়ত্রী মন্ত্রের রেকর্ড বিয়ের দিন সারাদিন ধরে চলতে থাকে।সম্ভবত এটাই ওনার গলায় রেকর্ডিং হওয়া শেষ গান।
যদিও তথ্য অনুযায়ী সিনেমার জন্য শেষ গান হিসাবে “সৌগন্ধ মুঝে ইস মিটটি কি” গানে রেকর্ড করেছিলেন যেখানে সুর দিয়েছিলেন মায়ুরেশ পাই।ভারতীয় সেনাবাহিনী ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি এই হিসেবে।এই ছবি মুক্তি পায় ২০১৯ সালে ৩০শে মার্চ।
সুরের দেবীর সাথে ছয়ের জাদুকরী – উপসংহারে নিজের ও একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত
সুধী পাঠক মন্ডলী নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত থেকে এটা লেখা।নিচের এই লেখার মধ্যে কোনো যথার্থতা আছে কিনা জানাবেন। আমি এত বড় মহান শিল্পীর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একটু সাহসের পরিচয় দিলাম,ভুল লিখলে মার্জনা করবেন। দুটো বিষয়েই আমাকে বেশ নাড়া দিল সংখ্যা ছয় ও মা সরস্বতীর সাথে তুলনায়, মনে হলো লিখতে গিয়ে সত্যিই কোথাও না কোথাও মিল খুঁজে পেলাম।
লেখার শুরুতেই বলেছি লতা মঙ্গেশকরের বাবা মেয়ের মধ্যেএই অসাধারণ মা সরস্বতীর প্রতিভা বুঝতে পারেন ঠিক যখন উনার ছয়মাস বয়স।মা বীণাপাণি হয়তো ঠিক সেই সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন সারেঙ্গীর তারের মাধ্যমে সেই ক্ষুদে আঙ্গুল দিয়ে সুরের সৃষ্টি করে লতা মঙ্গেশকরের জীবনে। যেটা উনার বাবা বাড়িতে বলেনও, নিজেও সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও করতেন,ছয়ের সূত্রপাত ঘটে সেই ছয় মাস বয়সকে কেন্দ্র করে।আবার লতা মঙ্গেশকর চলেও গেলেন সেই একই ছয় তারিখে।মা সরস্বতী নিজের পূজো নিয়ে এই ধরাধামে সঙ্গে নিয়ে গেলেন লতা দেবীকে যাঁর প্রতিভাকে নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে তাঁর ছয় মাস বয়সেই, আবারও নিয়েও গেলেন সেই একই ছয়েরই ঘেরাটোপে ।তাই এটি আমারই অভিব্যক্তি, ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।
Comments
I must thank you for the efforts youve put in penning this site. I am hoping to check out the same high-grade blog posts by you in the future as well. In fact, your creative writing abilities has motivated me to get my very own blog now 😉
THANKS FOR YOUR COMMENTS ITS INSPIRE ME A LOT TO WRITE, MY NEXT BLOG WHAT IS INTERNET,HOW ITS WORK