BMV-22 TEACHER WITH AN IDEOLOGY (APU SIR)
সুধী পাঠকমন্ডলী আজ এমন এক মানুষের জীবন কাহিনী আপনাদের অবগত করাতে চাই যিনি তাঁর সারাটা জীবন যেন উৎসর্গ করেদিলেন ছাত্রদের সেবায় শিক্ষকতার মাধ্যমে, বিন্দুমাত্র নিজের কথা না ভেবে বিলিয়ে দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে ।
তাঁর সমস্ত বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠার এক অনবদ্য বাস্তব জীবন কাহিনী । একটা অনুরোধ রইলো প্রত্যেকের কাছে একটু শেয়ার করার জন্য, নিজের এই লেখার জন্য কখনোই নয়, বিশ্বাস করুন এতটুকু মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছি না , তাঁকে দূরদূরান্তে লোকে জানুক, বুঝুক আজও এমন নিঃস্বার্থ মানুষ বেঁচে আছেন সেটা সকলের কাছে পৌঁছনোর জন্য ।
প্রতিনিয়ত পর্দার আড়ালে সমানে কাজ করে চলেছেন এক জীবন মুখী প্রতিভা । আশাকরি পুরোটা পড়লেই বুঝতে পারবেন তাঁকে নিয়ে কেন এই লেখা। আবারো অনুরোধ রইলো লাইক নয় শেয়ার করার জন্য, আজকের উদীয়মান ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এই অপূর্ব স্যার ।
জীবনে প্রায় সাতষট্টি ছুঁই ছুঁই এক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল যেমন তার পান্ডিত্য, তেমনই তার অপরিসীম জ্ঞান , সেটা সাহিত্যে, কলাতে, বা বিজ্ঞানে, দর্শনে, এমনকি আধ্যাত্বিকতা সমস্ত বিষয়ে পারদর্শী এক ব্যক্তিত্ব ।
আসি সেই দেবতুল্য মানুষটির কথাই নাম অপূর্ব রায়গুপ্ত । এই মহান ব্যক্তিত্বের একেবারে লাগোয়া পাশের বাড়িটি কে সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ চেনেন সেই বিখ্যাত স্লোগানে “ সুরভিত এন্টিসেপটিক ক্রিম………. “ আশাকরি এতক্ষনে বুঝতে পেরেছেন সেই প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ইমেজটির নাম।
মোটের উপর প্রায় একই জায়গায় দুইজন দিকপাল ব্যক্তিত্ব একজন পুঁজিপতি আর আরেকজন পান্ডিত্যের পাহাড় প্রমান । যদিও দ্বিতীয়জন কস্মিন কালে ও কোনো limelight আসতে পছন্দ করেননি বা চাননি।
এ প্রসঙ্গে আসছি পরবর্তী কালে, উনাকে নিয়ে লেখার বা বর্ণনা দেওয়ার সাহস জানি আমার এই লেখাতে সম্পূর্ণতা পাবে না , তাও লিখি একটা অধিকার থেকে কারণ উনার অনেক পরিচিতের তালিকায় আমি নিজেও কিছুটা হয়তো স্থান পেয়েছি।
যেটা উনি আমায় বলেন আমি নিজে নাকি প্রচন্ড ইমোশনাল প্রকৃতির মানুষ, আমায় তাই বার বার বলেছেন নিজের লাগাম টানতে, তা না হলে লোকে ঠকিয়ে দেবে, সেটা অবশ্য হয়েছে বহু ক্ষেত্রে, সেটা উনি জানেন ও । ভদ্রলোকের সাথে আমার যোগসূত্র স্থাপন হয় আমার মেয়ের ক্লাস নাইনে টিউশন কে কেন্দ্র করে, তাও আবার মেয়ের স্কুলের এক বন্ধুর মায়ের মারফত ।
ভদ্রমহিলার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ ও ঋণী হয়ে থাকলাম, কারণ এহেন মানুষটার সাথে উনি মধ্যস্ততা না করালে চিনতে বা খুব কাছ থেকে জানতেই পারতাম না। প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, এক জরাজীর্ণ পৈতৃক গৃহে তার বাস , চেককাটা লুঙ্গি পরনে , আর গেঞ্জি টা পিঠের দিকে ছেঁড়া, গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, মাথা ভর্তি পুরোটাই সাদা চুল।
আমায় বসতে বললেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে বেশ উদগ্রীব হয়ে দেখলেন আর আমায় বললেন “ আমি কিন্তু আপনার মেয়েকে টেস্ট না করে পড়াতে বা শিক্ষা দিতে রাজি নই, আগে দেখবো ও কতটা জানে , না জানলেও বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু পড়ার ব্যাপারে আগ্রহ কতটা সেটা জানা বিশেষ প্রয়োজন।
সেটা আমি বুঝলে তবেই আপনার মেয়েকে পড়ানোর সম্মতি জানাবো”। যাই হোক পরের দিন আবার যাই, উনি ইতিবাচক সম্মতি জানান, ঠিক হয় সায়েন্স গ্রুপ পড়াবেন সাথে ইংরাজি. বিশ্বাস করুন বিন্দুমাত্র সাহস হয়নি সেদিন উনার দক্ষিণা কত সেটা জানতে।
আমি নিজে কোনোদিন পারিনি উনার শিক্ষকতার দক্ষিনা উনার হাতে তুলে দিতে, বরাবর একটা খামে দিয়ে এসেছি, সেটাও আবার বাড়ির সাথে লাগানো দালানের পাশে একটা চেয়ারের উপরে উনাকে বলে রেখে দিয়ে আসতাম ।
বিশ্বাস করুন উনার চেহারায় কোনো রাশভারি নেই, কিন্তু যেটা আছে তা হলো এক নির্লিপ্ত দৃষ্টি, আর স্মিত হাসি, তাও একদৃষ্টে বেশিক্ষন তাকানোই যাই না এই মহান ব্যক্তিত্বের দিকে কোথাও যেন একেবারে মনের অনেক গভীর থেকে একটা শ্রদ্ধা জন্মায় মনে মনে ।
আসি উনার ব্যক্তিগত জীবনে সত্তরের দশকে তখনকার দিনে উনি ছিলেন WBCS এর A grade অফিসার, জীবনে একদিন মাত্র চাকরিতে গেছেন , তারপর ইস্তফা,কারণ একটাই অরাজকতা।
যদিও পরবর্তী কালে বার্নপুর স্টিলে চাকরি পান, সেখানেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন, এমনিতেই উনি BA পাশ, আবার করে শুরু করেন পড়াশুনা একেবারে science নিয়ে।
পাশাপাশি চর্চা চলে সংস্কৃত নিয়ে, সেখান থেকেই পথ চলা শুরু, উনার কাছেই শুনেছি সংস্কৃতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাতার অভিধান লেখা, সেটাও আবার উইয়ে অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে বছর দুয়েক আগে।
নিজের কিছু গচ্ছিত ধন প্রায় তিরিশ হাজারের মতো তোষকের নিচে রেখেছিলেন , মোদী সরকারের নোট বন্দিতে ভাঙানো হয়নি, সেটার ও প্রায় অধিকাংশ উইয়ের খাবারে চলে গেছে, একদিন বেশ বিষন্ন হয়ে বসে আছেন জানতে চাওয়াতে বলেন তাঁর বহু কষ্টের সংস্কৃতের অভিধানটি আজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
যদিও টাকা গুলো নষ্ট হওয়াতে উনার বিন্দুমাত্র দুঃখ নাই । এই মহান ব্যক্তিত্ব এককালে রাজ্যস্তরের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন বক্সিং এ, সেটা অবশ্য উনার মুখেই শোনা।
ইদানিং কালে উনি ব্যস্ত ইংলিশে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব কে নিয়ে লেখায়, সেটাও প্রায় আশাকরি চারশো পাতার উপরে লেখা হয়ে গেছে যদিও এখনো শেষ হয়নি।
আসুন রেখাপাত করি কয়েকটি বিষয়ে “একেবারে বাল্যকাল থেকে তাঁর সৃষ্টি, দৈনন্দিন জীবনের কর্ম লিপি , শিক্ষক হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি ও পড়ানোর ধরণ, জীবনে গান বাজনার প্রভাব, সর্বশেষ তাঁর দৈনন্দিন রান্নাবান্নায় নিপুণতা “উনার মুখেই শোনা।
যখন ক্লাস ফাইভে পড়তেন তৈরী করেছিলেন ডার্ক রুম বা অন্ধকার ঘর যেখানে তাঁর সৃষ্টি ছিল আগেকার দিনে ফুজি ফিল্ম মনে আছে, সেখান থেকে নেগেটিভ কেটে একেবারে ফটো তৈরী করা।
তখনকার দিনে একটা ফিল্ম থেকে তেরো বা চোদ্দটা ফটো তৈরী হতো , উনার উদ্দেশ্য ছিল যদি আরো ও বেশি ফটো বার করা যাই, ফিল্ম গুলোকে একেবারে নিখুঁত ভাবে কেটে, সেটা অবশ্য করতেও সফল হয়েছিলেন।
সুধী পাঠক মন্ডলী, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি মনে আছে নিশ্চয়, সত্যজিৎ বাবু কিন্তু সেই একই কাজ করেছিলেন পথের পাঁচালি তে। যেই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় সিন বা টেক বাদ দেওয়া যাই উনি সেটা বাদ দিয়ে একেবারে নিখুঁত ভাবে পরের সিনের সাথে যোগ করে দিতেন, কোথাও কোনো ভাবেই বোঝার উপায় ছিল না দর্শকের কাছে।
যদিও কাজটি খুব সহজ নই তাও আবার ডার্ক রুমে সেখানে পুরোটাই নির্ভর একেবারে কল্পনা শক্তি, আর অনুমান ভিত্তিক। আমার গল্পের ব্যক্তিত্ব ও কিন্তু এই কাজটা নিখুঁত করতে পারতেন তাও আবার অতো অল্প বয়সে, আবার কোনোরকম ফিল্ম সম্বন্ধে পূর্ব তালিম বা অভিজ্ঞতা না পেয়েই।
শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, শেক্সপীয়ার – তাঁরা তো তার জীবনে এসেছেন একেবারেই ছোটবেলায়, প্রতিটি গল্প আজও সমান ভাবে মনে আছে, যে কোনো কবিতা পুরোটাই তাঁর প্রায় ঠোঁটস্থ এই বয়সে এসেও, যে বয়সে এসে মানুষের স্মৃতি বিভ্রম হওয়াটা অসম্ভব কিছুই নই ।
ক্লাস নাইনে নিজের হাতে তৈরী দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যদিও এটা হয়তো অনেকেই বানিয়েছেন, কিন্তু যবে থেকে টেলিভিশন আমরা আমাদের বাড়িতে এনেছি, প্রায় সেই সময় থেকে উনার হাতে বানানো সার্কিট ডায়াগ্রাম একেবারে নিজের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, যদিও আটকে গিয়েছিলেন একটা জায়গায় সেটা হলো পিকচার টিউব জোগাড় করতে গিয়ে।
উনার থেকে শোনা উনি নিজে গিয়েছিলেন একটি সংস্থার কাছে যদি কোনো ভাবে তাদের থেকে সেই পিকচার টিউব সংগ্রহ করা যায়, তাতে অবশ্য পেয়েও ছিলেন, যদিও বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল উনাকে, সেই টেলিভিশন এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজমান।
টেলিভিশন সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার জ্ঞান ছিল বলেই উনাকে লোকে ডাকতেন, কিন্তু তা সারানোর মূল্য শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, উনার পারিশ্রমিক ছিল কতটা সময় উনি দিয়েছেন তার উপর, আর যে অংশটা খারাপ হয়ে যেত সেটা খুলে দিতেন গৃহকর্তা কে উনি যেন নিজে কিনে নিয়ে আসেন, কারণ একটাই মেরামতি ছিল তাঁর শখ কোনোদিন পেশা হিসেবে নেননি।
প্রসঙ্গত জানানো দরকার এই সমস্ত কাজে উনি যেতেন বহু দূর দূরান্তে, উনার পিতৃদেবের ব্যবহৃত আনুমানিক একশো বছরের পুরোনো হারকিউলিস সাইকেল করে, যার পেছনে লেখা “ MADE IN ENGLAND”।
যা আজও জ্বল জ্বল করে লেখা সাইকেলের পেছনে। জীবনে একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি উনাকে এই সাইকেলের পিছনে কারণ সম্পূর্ণ মেরামতি উনি নিজেই করেন।
এতকাল, সেটা টায়ার টিউব হোক বা, পুরোদস্তুর সাইকেলটা । ভাবলে অবাক হবেন কোনোদিন ডাক্তারের শরণাপন্ন হননি , অবসর সময়ে হোমিওপ্যাথি নিয়ে তাঁর চর্চা, ও তাঁরই পারদর্শিতাই নিজেকে নিজে ঠিক করতেন যে কোনো অসুখ বিসুখে ।
এমনকি পাড়ায় প্রচুর মানুষকে উনি বিনা পয়সায় ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। একটা ঘটনা বলি উনার পাড়ার একটি ছেলে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে একেবারে ছাদ থেকে পড়ে যায় , এবং নানান ডাক্তার দেখিয়ে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছয় সেটা হলো ছেলেটির মাথার চোট এতই গুরুতর যে অস্ত্রোপচার ছাড়া কোনো পথ নেই, এদিকে ছেলেটির বাড়ির আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তার অস্ত্রোপচার কখনোই সম্ভব নয়।
ছেলেটি দিনের পর দিন মানসিক ভারসাম্য হারাতে হারাতে প্রায় পাগল অবস্থা , তার মা একটা সময় তাকে হাত পা বেঁধে রাখতেন। যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা সেই মহান ব্যক্তিত্বের দিনের পর দিন হোমিওপ্যাথি ওষুধের সেবনে, ছেলেটি আজ প্রায় সুস্থ।
আসা যাক উনার দৈনন্দিন জীবনে, সকালে উঠে প্রায় ঘন্টাখানেক যোগা, সেটা কিন্তু আবার শারীরিক পরিস্থিতির উপর, সব দিন আমরা একই যোগা করি সেটা অবশ্য ঠিক নয়, এটা উনার থেকেই শেখা, এই প্রত্যেকটা যোগার পিছনে যে বিজ্ঞান আছে তার প্রত্যেকটা অকাট্য যুক্তি উনার কাছে আছে।
সেটা কিন্তু মোটেই ভিত্তিহীন নয় । তারপর শুরু হয় আহ্ণিক করা, উনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মায়ের একান্ত অনুরাগী ভক্ত আর বিবেকানন্দের আদর্শে পুরোটাই অনুপ্রাণিত ।
আহ্নিক শেষ করে শুরু হয় তাঁর দিনের কর্মসূচি, সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন ছাত্র ছাত্রীর বাড়িতে শিক্ষকতায় , উনার পড়ানোর বেশ কিছু ধরণ ধারণ আছে, যেমন ধরুন উনি একজনকেই পড়াবেন সেটাও আবার কোনো সময় বুঝে নয়।
কখনও পাঁচ ঘন্টা বা ছয় ঘন্টা আবার বেশির ভাগ সময়ে সারাটা দিন ধরে, তাতে অবশ্যই ছাত্র বা ছাত্রী কতটা ইচ্ছা শক্তি কাজ করে তার উপর। যেদিন উনার আহ্নিক করা হয়ে ওঠে না, সেদিন, পুরোদিনটাই উনি অভুক্ত থাকেন, এমনকি ছাত্র বা ছাত্রীর বাড়িতে জল ও খাননা।
আমি অবশ্য নিজেও আজ পর্যন্ত উনাকে জলও খাওয়াতে পারিনি , তার কারণ সম্বন্ধে পরে যেটা জানতে পারি সেটা হলো আরাধ্য দেবতাকে উৎসর্গ না করে উনি কিছুই খান না । সব থেকে অবাক হওয়ার মতন একটা মানুষ ছয় সাত ঘন্টা সমানে বকবক করে কি ভাবে জল না খেয়ে থাকতে পারেন, তাও আবার এই বয়সে।
আসা যাওয়া পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে, মাঝে মাঝে ভাবি কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা শক্তি না থাকলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় । যদিও উনি নিজে একেবারে অকপটে তা স্বীকার ও করেন। সাবলীল ভাবে বলেন নিজেকে পুরোপুরি তাঁর কাছে উৎসর্গ করতে পারলে তাহলে তাও হয়তো সম্ভব।
উনার খাওয়া দাওয়ার তালিকা শুনলে অবাক লাগে সকালে রুটি সবজি, বিকেলে ভাত বা রুটি সঙ্গে প্রচুর পরিমানে সবজি, আর রাত্রে জপ করে পরিমিত আহার। শুনেছি, জ্ঞানতো কোনোদিন দুধ খাননি, তাঁর যুক্তি হলো ওটা খেলে বাছুরের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়।
বাছুরের মুখের খাওয়ার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় ।এখনো পর্যন্ত উনার হাতে তৈরী ছাত্র ছাত্রী নয় নয় করে অগণিত, একেকটা ছাত্র ছাত্রীর শিক্ষা দেওয়ার ধরণ ধারণ একেক রকমের।
যে দুটো ছাত্রের ঘটনা আমায় বেশ ভাবায় প্রথম টি হলো এক ছাত্র যে ছোটবেলায় সম্ভবত ক্লাস ফাইভে বেশ কয়েকবার অনুত্তীর্ন হয়, অগত্যা তার মা বাবা ছেলেটিকে নিয়ে আসে উনার কাছে।
প্রথমেই উনি যেটা তার বাবা মাকে অনুরোধ করেন সেটা হলো হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার জন্য, বলেন প্রথম তিনমাস তাকে তালিম দেবেন একেবারে সা রে গা মা পা শেখানোয় আর প্রতি শনিবার ছেলেটিকে নিয়ে যাবেন বেলুড় মঠে ঠাকুরের কাছে প্রার্থণা করতে , এক অর্থে ঠাকুরের কৃপা পাওয়ার আশায়।
এ শুনে তার মা বাবাও অবাক হয়েছিলেন ছেলেকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এনেছেন এমন এক শিক্ষকের কাছে যিনি প্রথমে সম্মতি জানিয়েছেন গান শেখাবেন, তারপর পড়াশুনা। প্রথমটা নিমরাজি হলেও বাধ্যহন শিক্ষকের পরামর্শ মতো চলতে ।
ইদানিং সেই ছেলেটি বিদ্যুৎ পর্ষদে বেশ উচ্চ পদে কর্মরত । দ্বিতীয়জন হলো উনার এক মেধাবী ছাত্রীকে নিয়ে, ছাত্রীটির বাবা বারাকপুরে লাটবাগানের পুলিশ বিভাগের এক উচ্চপদস্থ অফিসার।
অপূর্ব শিক্ষক মহাশয় সেখানে পড়াতে যেতেন সেই চিরাচরিত সাইকেলে প্রায় দশ কিলোমিটার চালিয়ে, একদিন উনি বেশ অসুস্থ, এই খবর পায় ছাত্রীটির বাবা, তাই উনি দুজন কনস্টেবলের সঙ্গে গাড়ি পাঠিয়ে, উনাকে আনতে পাঠান।
উনার মুখেই শোনা, গাড়িটি উনি ফিরিয়েই দেন, উপরন্তু ছাত্রীর বাবাকে তার যথোপযুক্ত উত্তর ও দেন, তার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের জন্য । একে তো অসুস্থ শরীর, তার উপর আহ্নিক হয়নি, তার অর্থ সকাল থেকেই পেটে দানাপানি পর্যন্ত পড়েনি, সেই একগ্লাস জল খেয়েছেন কোন সকালে, কিছু একটা অঙ্ক হচ্ছিলো না ঠিক উনার মনোপূতঃ।
যথারীতি মনটাও বেশ খারাপ, সাইকেল চালিয়ে বাড়িমুখো হওয়ার পথে সারাটা রাস্তা শুধু একই চিন্তা কেন হলো না, প্রায় মাঝপথে এসে পৌঁছেছেন হঠাৎ তাঁর মনে পরে আসল ও সহজ ভাবে বোঝানোর পদ্ধতি, বিন্দুমাত্র দেরি না করে আবার ফিরে যান সেই ছাত্রীর বাড়িতে ও তাকে পুরোদস্তুর অঙ্কটা কষে সহজ করে দেখিয়ে আসেন ।
এথেকে কিন্তু দুটো সিদ্ধান্তে আশা যায় , প্রথমত জীবনে যে কোনো প্রলোভন এই মানুষটিকে কখনোই কাবু করতে পারেনি বা পারবে না তাই হয়তো উনি নিজের চাকরি থেকে একটা সময়ে ইস্তফা দিয়েছেন , দ্বিতীয়ত একজন শিক্ষকের ছাত্র ছাত্রীর প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা ও দায়িত্ব না হলে এধরণের চিন্তাভাবনা আসতে পারে না ।
একজন নির্ভেজাল ভালোমানুষের কাছ থেকে এটাই তো কাম্য, এই উৎস থেকেই তো একটা ভালো মানুষের জন্ম, এটাই তো জীবনের আসল শিক্ষা। তবেই তো সেই ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে একটা গঠনমূলক চরিত্রের সৃষ্টি হতে পারে।
এবারে আসি একেবারে নিজের কথায়, গতবছর অর্থাৎ 2019সন, ICSE পরীক্ষা খুব সম্ভবত মার্চ মাস মেয়ের ফিজিক্স পরীক্ষার আগেরদিন রাত প্রায় সাড়ে নটা হবে , সমানে বাইরের থেকে ডেকে চলেছেন মেয়ের নাম ডেকে , আমি তো অবাক, যাই হোক সদর দরজা খুলতেই উনি বলেন, আগামীকাল ফিজিক্স তো তাই একটু দেখিয়ে দিয়ে যাই।
সম্ভাব্য কি কি আসতে পারে পরীক্ষায়, উনি দেখাতে এসেছিলেন একটু, যখন গেলেন তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। যখন চলে যাচ্ছিলেন দুটো কথা বলেছিলেন এখনো মনে আছে, এবারে physics পেপারে যেটা আসবে খুবই সহজ কিন্তু একটু ঘোরানো, তবে সামান্য বুদ্ধির খেলা।
আর বলে গেলেন যদি অসুবিধে হয় যেন ফোন করে, প্রয়োজনে সকাল ঠিক পাঁচটায় উনি আসবেন। মেয়েকে ডেকে মাথার উপর কি জানি কিছু বিড়বিড় করলেন খুব সম্ভবত জপ্ করে চলে গেলেন ।
আমার সুধী পাঠকবৃন্দ, একটা কথা শেয়ার না করে পারলাম না, মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই গাড়িতে উঠে বসলো আর আমার ফোন টা চেয়ে বললো জ্যেঠু কে ফোন করবো, তারপর তোমার সাথে কথা বলছি, কেমন হয়েছে তখনই শুনো।
“ জ্যেঠু গতকাল রাতে তুমি যা যা বলেছিলে পুরোটাই মিলে গেছে, এমনকি প্রশ্ন গুলোও tricky ছিল যেটা বলেছিলে , প্রত্যেকটা প্রশ্ন মিলে গেছে হুবহু কোনটাতে কত নম্বর থাকবে, সেটাও বা কি করে মেলে জ্যেঠু ?, আমি তো question পেয়েই ভাবছি হলে যেন পাশে তুমি বসে আছো”।
মেয়ে ফিজিক্স এ পেয়েছিলো 96 out of 100। সুধী পাঠকবৃন্দ ভদ্রলোক ছিলেন মেয়ের কাছে জ্যেঠু স্যার, আর আমার আপনার কাছে limelight এ না আসা অপূর্ব মাস্টারমশাই। শেষ আর দুটো গুণাবলী না লিখলে হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটা হলো গানবাজনা, ও রান্না বান্নায় পারদর্শিতা।
বহুবার হয়েছে মেয়েকে নিয়ে যখন উনার কাছে গেছি পড়াতে, দেখি দরজা টা ভিতর থেকে ভেজান, উনি একমনে একটি বাটিকে একেবারে হাঁটুর উপরে রেখে তবলার বোল অভ্যাস করছেন।
উনি এতটাই মগ্ন যে বহুক্ষণ ধরেই একমনে বাজিয়েই যাচ্ছেন চোখের পাতা দুটো বুজে, কোথায় যে হারিয়ে গেছেন বোলের সাথে সাথে সেটা হয়তো উনিই জানেন। আর আমি অবাক হয়ে শুনেই গেছি সমানে।
শুনেছি যখন গলা সাধেন বেশিরভাগ টা রাতে প্রায় মাঝ রাতের দিকে কখনো রামপ্রসাদী গান আবার কখনও অতুল প্রসাদী গান, পাড়ার লোকেরা ভাবেন একজন পাগল, আর আমার মনে হয় তাঁর আবেগ তাঁর ইচ্ছে শক্তি হয়তো তিনি পুরো ষোলো আনা টাই উৎসর্গ করছেন তাঁর ইষ্টদেবতাকে।
এমনও দিন গেছে ঠাকুর, সারদা মা, বিবেকানন্দ কে নিয়ে বলতে বলতে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন, আর আমি আর মেয়ে সেদিন নিজেকেও আটকাতে পারিনি, আমাদের ও সিক্ত করেছিলো এক অনাবিল অদেখা উপলব্ধি।
রন্ধন শিল্পে বেশ পটু উনি, বর্তমান সমাজে মহিলাদের বেশ টক্কর দিতে পারেন খুব কম তেলে কিভাবে সুস্বাদু রান্না করা যায়, যে কোনো ধরণের মিষ্টি উনি খুব ভালোই বানাতে পারেন সেটাও ভীষণ নিখুঁত। আদতে উনি নিজেই হলেন আজকের কম্পিউটার যুগে google এর মতো একজন search engine যিনি কিনা সব পারেন।
একেবারে সঠিক ভাবে ।শুরুতেই বলেছিলাম যে ভদ্র মহিলার মাধ্যমে উনার সাথে আমার পরিচয়, আমি তাঁর কাছে ঋণী থাকবো এই রকম এক দেব তুল্য মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। সুধী পাঠকগণ গতবছর অর্থাৎ 2019 সনে, এনার সন্তান আমার মেয়ের স্কুলের সহপাঠী, ICSE তে সারা ভারতবর্ষের তৃতীয় স্থানাধিকারী, নাম স্বপ্নেস সিনহা- এক আলোড়ন ও নজির সৃষ্টি করে।
এই নামে তাকে google এ আপনারা সবাই পাবেন। ছেলেটি কিন্তু এই জ্যেঠু স্যারের ছাত্র আগাগোড়া থেকেই, এক দ্দায়িত্ব নিয়ে বলছি ছেলেটির অর্থাৎ স্বপনেসের বাবা মা আজও স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হন না তাঁর ছেলের এই চরম প্রাপ্তির জন্য একমাত্র ও শুধুই একমাত্র নাম যাঁর আসে তিনি হলেন স্যার, শ্রীযুক্ত অপূর্ব রায় গুপ্ত।
একান্তে ভেবেছি এই মানুষটার যে কতগুলো রূপ, কতগুলো প্রতিভা দর্শনের সৌভাগ্য হলো আমার এজন্মে, তাই এই আত্মতৃপ্তির প্রসাদ আমি একা নিতে পারিনা, ভাগ করে দিলাম সকলের কাছে আমার লেখার মাধ্যমে, অনুরোধ রইলো সমস্ত পাঠক মহলকে আমার এই লেখাকে নয় , এই দেবতুল্য মানুষটির কাহিনী একটু দূর দূরান্তে আপনাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চাই।
শেয়ার করতে চাই , আর হ্যাঁ যাঁদের পাঠাচ্ছেন তাঁরাও যদি এতটুকু তাঁদের লোকেদের শেয়ার করে তবেই আমার এই লেখা সার্থকতা পাবে। শেষ করছি এই বলে আমার এই লেখাটা কোনোদিন যেন তাঁর কাছে না পৌঁছয়, তাতে হয়তো উনার সাথে আমার এক মধুর সম্পর্কের বাঁধ ভেঙে যাবে। আগেই বলেছি উনি কোনোদিন limelight এ আসতে চাননি বা চাইবেন ও না।