BMV-7/5 রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- পঞ্চম ভাগ
লক্ষ্য যেখানে স্থির, সংকল্পটা হোলো মনের গভীরে বাঁচিয়ে রাখা একটা প্রদীপের দপদপ করতে থাকা শিখা। শুধুই অল্প একটু তেল বা জ্বালানি সেই শিখাকে যেমন উজ্জীবিত করে, জিইয়ে রাখে তেমনটাই আমার সংকল্পের কাহিনী।কিছু করতে হবে এটাই বুঝি আল্লাহ হয়তো পরীক্ষা নেন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে। যাঁর যত কঠোর পরীক্ষা তাঁর তত বেড়ে ওঠার সিঁড়িটা হয়তো সহজ হয়ে ওঠে একটা সময়ে,এটাই আমার মনের বিশ্বাস।সেটা মানুষ বোঝেন অনেকই পরে যখন সাফল্য এসে ধরা দেয়।আমার অনেক কষ্টের জমানো সাতাশশো টাকা মুহূর্তে আমাকে শূন্য করে দিল, তাও হার মানিনি।
মনকে বলেছি ওটা আমারই দোষ, ঐ যে হোটেলের লোকেদের থেকে চলে যাওয়ার সময় টিপস চাইতাম, সেটা আমার হকের পাওনা নয়, সেটা আমার রোজগারের অর্থ নয়, কখনোই হতে পারে না, সেটা ছিল আমার ঘুষ। আল্লাহ রহমত সব দেখেন, তাই সেটারই শিক্ষা পেলাম।আমার সেই বছরে আর এগারো ক্লাসে ভর্তি হওয়া হোলো না।ভাবলাম এভাবে হোটেলে কাজ করলে মাসের শেষে মাইনা সেখান থেকে নিজে চলবো কি আর পড়াশুনোর জন্য টাকা রাখবো কি, এভাবে জীবন চলতে পারে না।
টাকার প্রয়োজনও আছে এই মুহূর্তে, কাজ করবো সঙ্গে সঙ্গে টাকা -এটাই মাথায় ঢুকলো। আমি পুরো ঢাকা শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতাম আর দেখতাম মানুষ কি করে টাকা রোজগার করে। এমনও হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম কোনো কোনো জায়গায় কাজের জন্য নয়, তারা কি কথা বলে, কি ভাবে চলে, এটাই বোঝার জন্য।
ঢাকা শহরে বাদামতলী একটা জায়গা আছে সেটা ফলের আড়ৎ ভাবলাম এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি মজুরীর কাজ করলে, ফল পৌঁছে দিলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাবো, সময় নষ্ট না করে, হোটেলের কাজ ছেড়ে লেগে পড়লাম এই কাজে।
বেশ কিছদিন কাজ করার পর একজন ভালো মানুষের সাথে পরিচয় হোলো। উনি বললেন তুমি তো কিছুটা হলেও লেখাপড়া করেছো এই ভাবে মজুরীর কাজ না করে ফলের ব্যবসা করো।প্রয়োজনে আমি টাকা দেব পরে না হয় ফেরৎ দিয়ে দিয়ো।মজুরীর কাজ করতে করতে ইতিমধ্যেই প্রায় মাসখানেকে হাজার দুয়েক টাকা জমিয়ে ফেলেছি।
এবার আর ভুল করিনি কারোর কাছে টাকা রাখতাম না এমনকি ব্যাগেও না। একটা সুতো ও সূচ রাখতাম সবসময় নিজের কাছে, যখন বেশ কিছু টাকা হতো সেটা প্যান্টের নিচে যেই জায়গাটা মোড়া থাকে সেখানটা কেটে টাকা গুলো ছোট্ট প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে সেলাই করে রাখতাম, সারাদিন কাজ করতাম তাই পানিতে যেন ভিজে না যায়। কারণ একটাই,বেশিরভাগ রাতের সময় শোয়ার জায়গা পেতাম না তাই হাঁটতাম, তখন নানান ছিনতাই দল আমার উপর হামলা করতো কিন্তু কিছুই পেত না।
পরিশ্রম বেড়েই চললো কিন্তু কুল কিনারা পেলাম না। অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে করতে ও ঠিক মত খাওয়ার না পাওয়াতে জন্ডিস ধরা পড়লো সমস্ত গা নিমেষেই হলুদ হয়ে গেলো।যে যেরকম বলে সেই ভাবে চলি কেউ বুদ্ধি দিল ডাব পোড়া, কবিরাজি কিছুতেই কিছু হোলো না।
একজন নাম করা কবিরাজের কাছে গেলাম উনি বললেন দুই হাতের দুই দিকে অল্প কাটতে হবে ও গায়ে গাছ বেঁধে দিলে,তাতেই জন্ডিস কমে যাবে তাও করলাম।কিন্ত কিছুই হোলো না। অবশেষে বহু ডাক্তার দেখিয়ে আমি ভালো হই। ফলের ব্যবসা চলছিল মোটামুটি কিন্তু সেখানেও তোলাবাজ পুলিশের উৎপাত সেটাও ছেড়ে দিলাম। মন একেবারে এতই ভেঙে পড়েছে আর লড়াই করতে পারছি না কি করি আবারও ফিরে গেলাম কাজের সন্ধানে।এবারে এক ষ্টুডিও তে কাজ পেলাম মাসিক বেতন ষোলোশো টাকা।
কাজ অফিস তদারকির। দেখি সেখানে কম্পিউটার ও আছে ও যিনি সেটা চালান মালিক তাঁকে কদর করে, মাইনাও বেশি তিনহাজার টাকা। আমার তো খুবই ইচ্ছে কম্পিউটারটা যদি শিখতে পারি। একদিন সকালে ঝাড় দিতে দিতে গিয়ে ইচ্ছে হোলো মাউসটাকে নাড়িয়ে দেখি কিভাবে চলে তাতেই হোলো যত বিপত্তি।সেটা নাড়াতেই দেখি বন্ধ হয়ে গেলো।
আমি ঘটনাটা যিনি কম্পিউটার চালান তাঁকে বলতেই আরো বিপত্তি হোলো উনি বললেন তুমি ঝাঁটা হাতে ধরেছো তাই ভাইরাস ঢুকে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।এবারে তো ঠিক করতে হলে অনেক টাকা লাগবে।আমি তো ভয় পেয়ে সেই লোককে হাতে পায়ে ধরি, বলি ভাই ওটা ঠিক করতে যা পয়সা লাগবে আমি দেবো কিন্তু মালিককে বোলো না,তা না হলে আমার চাকরিটা খোয়াবো।
তিনশো টাকার বিনিময়ে সে রাজি হয়, এখন বুঝি কম্পিউটারটা তখন সেভ মোডে হয়ে গিয়েছিলো। একটাই জিনিস জীবনে বুঝেছি, সুবিধাবাদী লোকজন ওঁৎ পেতে থাকে ভুল ধরার জন্য আর কিভাবে অন্যের থেকে অর্থ আদায় করা যায় প্যাঁচে ফেলে।মানুষ যখন খুব বেশি অসহায় হয় তখন হয়তো সব মানুষই সুযোগ নেন তাঁর কঠিন সময়ের মধ্যে।
মনে আবারও নতুন সংকল্প নিলাম, যত বেশি কেউ দমিয়ে রাখবে ততই শিক্ষার ও জানার প্রতি সংকল্পটা আরো মজবুত করবো। কারণ এই একটাই জায়গা যেখানে কেউ ঢুকতে পারবে না সেটা হোলো আমার মন বা ইচ্ছের প্রতিশ্রুতি নিজের কাছে।পড়াশুনার পাশাপাশি কম্পিউটারটা শিখতেই হবে ওটা শিখলে অন্তত আমি আরো ভালো ভাবে দাঁড়াতে পারবো এটাই আমার আগামী স্বপ্ন।
এখানে আর বেশি দিন কাজ করিনি বুঝেছি এখানে থাকলে আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না জীবনে মাইনাটাই সব নয় যদিও চূড়ান্ত অভাব আছে। “আরেকটা জিনিস জীবন থেকে বুঝেছি টাকার পিছনে ছুটলে সেটা আসবে না,ওটা পিচ্ছিল কাগজ, অনেকটা সাবানের মত, মস্তিষ্কে যেটা সঞ্চয় করবো ওটাই আমার পুঁজি আর আমার অবিরাম কর্মই সারাজীবনের জন্য আমাকে এনে দেবে টাকা”।
এখানের কাজটা দিলাম ছেড়ে কিছু উন্নতি হবে না ভেবে চলে চলে গেলাম “মীরপুর ডিজিটাল কালার ল্যাব” এ নতুন চাকরি পেয়ে। উদ্দেশ্য একটাই সেখানে কম্পিউটার না জানলেও তারাই শিখিয়ে দেবে আর মাইনা প্রায় বত্রিশ শো টাকার কাছাকাছি। হাতে টাকা আর পড়াশুনো করার ইচ্ছে নিয়ে এবারে কলেজে ভর্তি হলাম সপ্তাহে দুই দিনের ছুটি ও পেলাম কলেজ যাওয়ার জন্য।
যেই মেসে আমি থাকতাম সেখানে সকলে শাড়ির দোকানে জরির কাজ করে, সারাদিন তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আমার সময় ঐ রাতেই পড়াশুনো করার। এভাবে রাতে পড়তাম লাইট জ্বালিয়ে কিন্তু ওদের অসুবিধে হতো তাই তারা কর্তৃপক্ষকে আমার উদ্দেশ্যে নালিশ জানান একদিন আমাকে তারা সেই মেস থেকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দেওয়ার মত করে বার করে দিল।
মনে ভাবলাম সত্যিই তো তাদেরই বা কি দোষ। এরপর ঠিক করি এমন এক মেস নেবো যেখানে আমার থাকার জায়গাটা হবে একেবারে জানালা ঘেষা উদ্দেশ্য রাতে সবাই শুয়ে পড়লে রাস্তার আলো তো জানালা দিয়ে ঢুকবে তাতেই চলবে আমার পড়াশুনা আর অন্যদের রাতের নির্বিঘ্নে ঘুমে কারোর অসুবিধে হবে না, পেয়েও গেলাম তেমন মেস।
কলেজে এগারোর পরীক্ষা দিলাম খুব মন দিয়ে, নিজে খুবই সন্তুষ্ট যে পাশ করবো খুবই ভালো করে। রেজাল্ট বের হোলো, আমি সাহসের সাথে এই প্রথম গেলাম পাশের খবর জানতে। কিন্ত গিয়ে দেখি আমি ফেল করেছি, অদ্ভুত লাগলো যে কয়দিন আমার পরীক্ষা ছিল আমাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে খাতায়, তাই পাশের খবর তো দুরস্ত।
মন মানলো না গেলাম প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে সব ঘটনা বলি উনি একই কথা বলেন তুমি পরীক্ষা দিতে আসোনি আবার বলছো ভালো পরীক্ষা দিয়েছো এটা কি করে সম্ভব, এমনিতেই রেজিস্টার দেখে উনি বলেন তুমি পুরো মাসে আট দিন স্কুল করেছো , কি করে তুমি বলো পরীক্ষা দিয়েছো, এই বলে উনি আমায় বার করে দিলেন আর কোনো কথা না শুনে।
এতিমধ্যে এই প্রিন্সিপালের বদলি হয়ে গেলো নতুন প্রিন্সিপাল এলেন মন আরো ভেঙে পড়লো এবারে আর কি হবে, সব শেষ নতুন প্রিন্সিপাল আমার কথা শুনবেনই বা কেন উনার তো বহু কাজ নিজের কাজ করবেন না আমার আর্জি শুনবেন।
তাও মন মানলো না সাহস করে গেলাম কিন্তু দারোয়ান আটকে দেন কোনোভাবেই দেখা হোলো না। মন বলে আরেকটা সুযোগ আছে যখন উনি নামাজে যাবেন আমিও নামাজ পড়বো উনার পাশে, সেখানে তো কেউ আটকাতে পারবে না।নামাজের শেষে পরিচয় করে উনাকে পুরো ঘটনাটা বলি।
এমনিতেই নতুন প্রিন্সিপাল আসলে উনাদের একটা সদিচ্ছা থাকে স্কুলের জন্য ভালো কিছু করবো, ভালো কাজ করবো, সেখানে প্রথমেই আমার এই ঘটনাটা উনাকে বিচলিত করলো। উনি বললেন তুমি কি বোঝো যে তুমি সমস্ত স্যারেদের বিরুদ্ধে চলে গিয়ে প্রতিবাদ করছো এটা কি কখনো হয় নাকি।
তাহলে তোমার নিজেরই শত্রুতা আছে উনাদের প্রতি তাই তুমি মিথ্যে বলছো। বলতে বলতে উনি আমার উপস্থিতির খাতা টা আনতেই আমার উপর রেগে গেলেন সেই একই কথা বললেন। আমি বলি স্যার আমার সমস্যার কথা বললে আপনার পুরাটা দিন চলে যাবে তাও শেষ হবে না একটাই কথা বলতে পারি আমি পরীক্ষা দিয়েছি ও মনের বিশ্বাস আমি খুবই ভালোভাবে পাশ করেছি।
উনি কি বুঝলেন জানি না আমাকে বসিয়ে রেখে উনি গেলেন পাশের ঘরে পরীক্ষায় উপস্থিতির খাতায় আমার সই আছে কিনা দেখতে। কিছুক্ষন পরে এসে চুপ করে বসে আছেন কিছুই বলেন না আমিও উনার দিকে তাকিয়ে আছি কিছু তো একটা বলবেন। দেখি বেল টিপে পিয়নকে বলেন আমাদের ক্লাস টিচারকে আসতে।
উনি আসার পর উনাকে বলেন কি ব্যাপার এই ছেলেটিকে পরীক্ষায় অনুপস্থিত কেন দেখানো হয়েছে? ক্লাস টিচার কিছু বোঝার আগেই প্রিন্সিপাল বলেন এই ছেলেটির পরীক্ষার সবকটা খাতা একটু আনতে। টিচার তো প্রিন্সিপাল কে বলেই গেলেন স্যার ছেলেটি কলেজে আসে না তার আবার পরীক্ষার খাতা কোথায় পাবো।
এটা শুনে প্রিন্সিপাল উনাকে বলেন আপনি বসুন আমি দেখছি। প্রিন্সিপাল একজন ক্লারিক্যালের লোককে ডেকে সব খাতাগুলো আনতে বলেন, সেটা পাওয়ার পর দেখি উনি আরো চুপ,পরপর দুই গ্লাস পানি খেলেন আর পায়চারি করছেন কি বোলবে।
আমি তো আরো ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু নিজের উপর বিশ্বাস হারায় নি। পরে বুঝেছি ক্লাস টিচার নিজেও বুঝেছেন তাঁর ভুলটা কোথায় উনি সমানে চলে যেতে চাইছেন আর বলছেন স্যার ছেলেরা ক্লাসে বসে আছে,আমি আসি পরে না হয় আপনার সাথে কথা হবে।
প্রিন্সিপাল দেখি অত্যন্ত নরম সুরে স্নেহের সাথে আমার নাম ধরে বললেন লালন তুমি বাইরে যাও আমি ডাকলে এসো একটু অপেক্ষা করো আগে স্যারকে ছেড়ে দেই,উনার ক্লাস আছে তো তাই।আমি বাইরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছি ডাকে আর না, দেখলাম প্রিন্সিপাল স্যার আমায় প্রায় আধঘন্টা পরে ডাকলেন।
কিছু না বলে পরীক্ষার খাতা গুলো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন,আমি খাতা দেখে তো অবাক। খাতার নিচে লাল পেনে দাগ কাটা ফেল ওটা বুঝলাম না, অথচ প্রতিটা পেপারে এ গ্রেড লেখা একবারে উপরের বাঁ দিকে, বুঝলাম আমিই এই ক্লাসের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি।
কিছু বলতে গেলে প্রিন্সিপাল আমায় চুপ করতে বলেন,আমি উঠে গিয়ে উনাকে পা ধরে প্রণাম করাতে উনি জড়িয়ে ধরলেন, সত্যটা জানা হোলো না কেন ওমন হোলো। অনেক পরে বুঝতে পারি আসলে একজন ছেলে পুরোটা মাসই ক্লাসে অনুপস্থিত, বিশেষ একটা দেখাও যায় না,সে কি করে সর্বোচ্চ নম্বর পেলো এটাই ছিল তাঁদের মূল কথা।
কি জানি চুরি করে পাশ করেছে কিনা এটা ছিল মনের সংশয়। তাই আমাকে উনারা পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেখিয়েছেন।
আসছি পরের শেষ অধ্যায়ে লালনের চূড়ান্ত সাফল্য যা তাকে নিয়ে গেছে অসীমের দিকে যেটা সে নিজেও কখনো ভাবেনি ।
BMV-7/6 রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- ষষ্ঠ ও শেষ ভাগ
ক্রমশঃ……….