BMV-42 হিমাচলের পথে অন্তর্জলি যাত্রা
আমার রহড়া মিশন কলেজের বন্ধু অনন্ত দেব মুখার্জি অত্যন্ত বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক সেই সময় যেমন ছিল এখন সখ্যতা আরো বেশি বৈ কম নয়।মাঝে দীর্ঘদিন সে আহমেদাবাদে কর্মরত ছিল তাও যোগাযোগ টা ছিল ঠিক গুড মর্নিং এর মত দায়সারা বন্ধুত্ব নয়, বরং কুশল বিনিময়ের কথা হতো মাঝে মধ্যেই ।
গতকাল ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ আমাদের মিশন কলেজের আরেক বন্ধু নাম হিটলার আমায় ফোন করে একটা দুঃসংবাদ দেয়, তাতে বেশ মর্মাহত হলাম।অনন্তর দাদা ভাস্করদার এক অকাল মৃত্যু আমায় নাড়িয়ে দিল মুহূর্তে।ফোনটা আসতেই কিছুটা মুষড়ে পড়েছিলাম। কত পুরনো স্মৃতি আছে তাঁর সাথে। প্রথমেই যেটা মনে পড়ছিল ভাস্করদার সম্বন্ধে ছিপছিপে রোগাটে গড়ন,দেখলেই স্মিত হাসি, ডান কাঁধে একটা কাপড়ের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলতো,অসম্ভব ফর্সা এই ছিল ভাস্করদার একটা চেহারা গত আকৃতি।
পেশায় উনি ছিলেন ইউনাইটেড ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক ম্যানেজার বয়স আনুমানিক একষট্টি বছর। হিটলারের ফোন আসতেই ছুটে গেলাম ব্যারাকপুরে অনন্তের সাথে দেখা করতে।ভাস্করদা থাকতেন ব্যারাকপুরে ঠিক চোদ্দো নম্বর রেল গেট পেরোলেই স্টেট ব্যাংক তারই উলটো দিকে সেন্ট্রাল রোড অল্প কিছুটা এগোলেই বাম হাতে মিডল রোড সেখানেই এক ফ্ল্যাটের চারতলায়।
পেশা ছাড়াও যে মানুষের আরো কত ধরনের নেশা থাকে সেটা অনন্তের সাথে দেখা হতেই জানতে পারলাম। ভাস্করদার বিশেষ রুচি ছিল ফটোগ্রাফিতে খুব ভালো ফটো তুলতেন। এরপর আরেক চমকপ্রদ নেশা ছিল “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎ টাকে” অর্থাৎ সেটা ছিল মাউন্টেনিয়ারিং।যা শুনলাম উনি অবলীলায় একেরপর এক পাহাড় পেরিয়েছেন জীবনে দীর্ঘ কুড়িটা বছর ধরে।ইতিমধ্যেই একটা ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের স্কুল ও প্রতিষ্ঠা করেছেন এই ব্যারাকপুরেই।আগাম স্বপ্ন দেখেছিলেন বৃদ্ধাশ্রম করবেন তাই জমি ও কিনেছিলেন ঠিক স্টিভ ওয়ার (অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার) সেবা প্রতিষ্ঠানের পাশেই ব্যারাকপুরে।
অনন্তদের পরিবারটা বেশ বড়,অনেকগুলো দাদা দিদি, আর অনন্ত সর্বকনিষ্ঠ। একটা বেশ ভালো লাগা ছিল ওদের বাড়িতে যেতে কারণ প্রায় প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত ও সংস্কৃতি জগতের মানুষ কিন্তু দেখে ঠিক ঠাওর করার উপায় নেই কাউকেই।অনন্তের বড়দা একজন IAS অফিসার থাকেন দিল্লিতে অনেকটাই বড় আমাদের থেকে উনি নিজেও IAS ট্রেনিং সেন্টার শিমলার সাথে যুক্ত। আমার লেখা শুভ সূমেধার কাহিনীতে “চুরি” অধ্যায়টা এই অনন্তদের পরিবারেরই এক সত্য ঘটনার কাহিনী অবলম্বনে লেখা।
যাক হিটলারকে নিয়ে পৌঁছতেই দেখা হলো অনন্ত ও তাঁর বৌদির সাথে কিছুটা হালকা আলোচনাও হলো।কেমন করে ঘটলো কি ভাবে হলো এতসব শুনছিলাম। তাঁদের একমাত্র ছেলে থাকে USA তে।গতকাল অর্থাৎ ২৪/০৯/২১ তারিখে খবর পেলাম ২৪ঘণ্টায় প্রায় সারাদিন এই খবর দেখানো চলেছে। দুই জন মৃত বাকি চারজন বেস ক্যাম্প থেকে শেরপার (পোর্টার) সাথে নিচে নেমে এসেছেন।বাড়ির লোকজন এই পর্যন্তই জানেন বাকিটা আনুমানিক বা ধোঁয়াশা টেন্টে ঘুমিয়ে ছিলেন হয়তো অক্সিজেনের অভাবেই মারা গেছেন।যদিও পার্থিব শরীর গতকাল পর্যন্ত নিচে এসে পৌঁছয় নি।
অনন্তর বড়দার চাকুরীর সুবাদে একটা ভালো রকমের influence আছে নানান মহলে তাই হয়তো Home Ministry থেকেও কিছুটা হলেও তড়িঘড়ি পার্থিব শরীরটাকে আনানো সম্ভব হবে।আজ দেখলাম আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর প্রকাশ পেলো।একজন কৃতিমান মানুষের শেষকৃত্য ও যে কতটা আলাদা অন্যের থেকে সেটা হয়তো জমে থাকে তাঁর সারাজীবনে এক সফল কর্মফলের নিদর্শন হিসেবে।মৃত্যু আমাদের জীবনের চরম সত্য এটা ঠিক কিন্তু সেই মৃত্যু যদি জীবনের শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে হিমালয়ের বুকে পঞ্চভূতে বিলীন হয় এমনটা কৃতীমান ও ভাগ্যবান মানুষ ছাড়া হয়তো খুবই কম মানুষের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়।
আজ ABP আনন্দে অনন্তর দেওয়া এক সাক্ষাৎকার, মদন মিত্র ও পরিবহন মন্ত্রীর সাথে কথা বলা, এমন প্রয়াসে হয়তো আরো সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ভাস্করদার পার্থিব শরীরটা তাঁরই ব্যারাকপুরে বাসভবনে আনা সম্ভব হবে।দাদা তোমায় মনে থাকবে আজীবন, মনে রাখবে কলকাতাবাসী তথা সভ্য সমাজ। একই জীবনে অনেক কিছুই করা সম্ভব এটা ভাস্করদা তোমার থেকেই শিক্ষা নিলাম।জীবন একটাই তাই ইচ্ছেগুলো সবটাই হয়তো পুর্নতা পায় না, অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে চলে গেলে ঘুমের দেশে আবার এসো দাদা আগাম জন্মে ভাই হিসেবে এতটাই বলতে পারি সেদিন আবারও দেখা হবে এক নতুন তেনজিং হিসেবে তোমাকে হিমালয়ের শিখরে।