destruction from target

BMV-46 লক্ষ্যভ্রষ্ট

জীবনের লক্ষ্যটাই হলো আসল আর ভ্রষ্টটা হলো অনীহা বা বাধা যেটা পথ দেখায় নানান অজুহাত।পূর্বেই একটা লেখায় বলেছি মানুষের তিনটে হাত যেখানে ডান কিংবা বাম হাত মানুষের কর্মক্ষমতা থেকে মানুষকে দিনের পর দিন তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে সেখানেই স্থান পায় তৃতীয় হাত অজুহাত।

আমারই এক ব্যবসায়িক সূত্রে সুদীর্ঘ পথের বন্ধু যাঁর নাম মহাম্মদ হাবিব।তাঁর সম্বন্ধে দুই একটি কথা না লিখলেই নয়, জ্ঞানের ভাণ্ডার বললেও কোনো অত্যুক্তি নেই তাঁর সম্বন্ধে। রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,শরৎচন্দ্র ছোটবেলায় সেই স্কুল জীবনেই শেষ করে ফেলেছে সে।দীর্ঘদিন এমন ও হয়েছে হাবিবের সাথে টানা চলেছে তিন থেকে চারঘন্টা দীর্ঘায়িত আড্ডা ফোন মারফৎ এমন সব লেখকদের উপন্যাস নিয়ে এক সবিস্তার ব্যাখ্যা।যেটা অবশ্য আজও চলে।

আমি একপ্রকার বধির হয়ে শুনি তাঁর কথা।শ্রীকান্ত চরিত্র নিয়ে তিনি যখন বলেন এপাশ থেকে আমি ভাবি কতটা পাণ্ডিত্য থাকলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারেন এই মানুষটা।আমি নিজে কখনোই তলিয়ে ভাবিনি হাবিবের মত আজ অনেক কিছুই ভাবায়।মানুষটার পোশাক আশাকের তেমন কোনো বাহার নেই প্রায়শই গাল ভর্তি দাড়ি, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক,হাত গুটিয়ে জামা পরেন, প্যান্টটা নিচের দিকে বেশিরভাগ সময়েই দুই ধাপ মোড়া।

জিজ্ঞাসা করলেই একগাল হেসে বলেন “ দেবপ্রিয় নামাজ মে গিয়া থা তো, তভি সে ওয়াইসেহি হ্যায়, জরুরত নহি সমঝা সাম কো তো ফির জানা হ্যায় নামাজ মে উসলিয়ে….” জীবন ও নিজের  চাকচিক্য সম্পর্কে কতটা উদাসীন থাকলে এমন কথা বলতে পারে ।এতক্ষণ বললাম তাঁর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনার কথা, ইংরেজি ও আরবি ভাষাতেও সমান দক্ষতার মানুষ তিনি।ইংরেজির শব্দ ভাণ্ডার এমনই যে কথা বললেই বেড়িয়ে অসে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ।

জামাকাপড় এযাবৎ পাঁচ কিংবা ছয় সেটের বেশি নয়, যেটা আছে দুই কামরা বিশিষ্ট ফ্ল্যাটে আনুমানিক হাজার দুয়েকের বেশি সংগৃহীত বই তিনটি ভাষা মিলিয়ে। মেয়ের কাছেও হাজার খানেক নভেল শেকসপিয়র, কিটস, সেটা অবশ্য মেয়ের সংগৃহীত।এই মুহূর্তে মেয়ে এগারো ক্লাসে পড়ে।

জীবনের লক্ষ্য স্থির করে ঠিক কেমন অবিচল হওয়া উচিত সেটা তাঁরই থেকে প্রতিদিন শিখি, কতটা নিতে পেরেছি আজও জানিনা।বছর তিনেক আগের কথা কলকাতায় ম্যারাথন দৌড় হবে বিভিন্ন নামিদামি লোক সেখানে থাকবেন সাধারণ মানুষ তো আছেই।হাবিবের মনের গভীরে ইচ্ছে সে নিজেও অংশ গ্রহণ করবেন।এটা ছিল তাঁর সংকল্প।কথা বলে বুঝলাম সংকল্প ও লক্ষ্যের মধ্যে এক চুলের তফাৎ সেটা মনন।যে কোনো কাজ করবার আগে সেটা মন থেকে একাগ্র হয়ে সংকল্প করতে হয় সেটার জন্য ভাবতে হয়, মনে জায়গা করতে হয় প্রতিনিয়তই তবেই সংকল্পটা লক্ষ্যে পরিণত হয়।

ম্যারাথন দৌড়ে হাবিব যাবেন তাঁরই অনুশীলন চলে মনে মনে বেশ কিছুদিন।এই মানসিক প্রস্তুতি চলতে চলতে মনে সংকল্পের লক্ষ্য স্থির করেন।প্রসঙ্গত বলা দরকার সে থাকে পার্ক সার্কাসে ট্রাম ডিপোর কাছে।শুরু করে দেন তাঁর ভোরবেলায় উঠে অনুশীলন।একেবারে পার্ক সার্কাস থেকে থিয়েটার রোড হয়ে বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম সেখান থেকে ময়দান চারপাক আবারও হাঁটতে হাঁটতে পার্ক সার্কাস।একদিন ময়দানে হাঁটতে হাঁটতে সজোরে বৃষ্টি নামে ,যদিও  আকাশের অবস্থা দেখে রেন কোট সাথেই নিয়ে রেখেছিলেন,তাই রেন কোট টা পরে আবারও হাঁটা।

এটাই ছিল তাঁর চলার পথে প্রথম বাধা যা তাঁর মনের সংকল্পকে কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত করেছিল কিন্তু সেটাকেও কাটিয়ে এর পর শুরু হয় সেই একই পথে হাল্কা দৌড় ম্যারাথনের প্রয়াস।যেহেতু জীবনের লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছেন তাই এই সম্বন্ধে বেশ কিছু বইপত্র কেনাকাটি করে শুরু করেন পড়াশুনা যা তাঁকে হয়তো সাহায্য করবে দৌড়তে এটাই তাঁর বিশ্বাস।সেই বইয়ের লেখা একটা উক্তি মনে বেশ দাগ কেটেছিল হাবিবের মুখে শুনে “ if you can’t effort to buy shoes for marathon then don’t run”

Marathon Medal

সত্যিই সত্যিই কথাটার যথার্ততা যাচাই করতে বেড়িয়ে পড়েন জুতো কিনতে ধর্মতলায়।একটিও দোকানে সেই জুতো পাননি অনেক দোকান ঘুরেও। অবশেষে ডাক্তারের পরামর্শে ঠিক কেমন জুতো কেনা দরকার কিনেছিলেন অর্ডার দিয়ে সেটাও বহু দাম দিয়ে।ওই যে একটা সংকল্প যেটা লক্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অবশেষে ম্যারাথন দৌড়ে বিজয়ী হয়েছিলেন।

আমরা অনেকেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হই ঠিক এই জায়গাটাতে।হয় কোনো অজুহাত অর্থাভাব কিংবা বয়সের ছাপ হাবিব আমারই বয়সী বাহান্নর কোঠায়।বলার অর্থ এটাই যেকোন সাফল্যের পেছনে পরিশ্রম, একাগ্রতা, চিন্তন ও মনন একদিনে হয় না তার ক্ষেত্রে চলে দীর্ঘ অন্তর্নিহিত প্রয়াস।আমরা অনেকেই হয়তো এমন সব হাবিবকে নেপথ্যে উপহাস, ঠাট্টা, তামাশা করি কারণ ওটাই যে আমাদের কাছে অন্যকে ছোটো করার মারণাস্ত্র আর সেখানেই হাবিবের মত মানুষের নিজের কাছে সাফল্য।হাবিব করে দেখিয়েছিল কেমন করে ম্যারাথন জয় করতে হয়।

ইদানিং কালে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বহু চর্চিত বিষয় “স্ত্রীর সাথে ঝগড়া বাকবিতন্ডা থেকে পথ নির্দেশক নামে এক লক্ষ্যের সৃষ্টি”। যদিও অনেকেরই জানা তাও বলি যেকোনো সৃষ্টির পেছনে একটা পূর্ব ইতিহাস বা কাহিনী থাকে তা না হলে সৃষ্টির উৎপত্তি সম্ভব নয় সম্প্রতি আমি নিজে তা মানি ও বুঝি।আসা যাক ভদ্রলোকের কথায় স্ত্রী কে কথা দিয়েছিলেন রাতে  দুজনেই যাবেন স্থানীয় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে।

যথাসময়ে স্ত্রী বেড়িয়ে পড়েন , ভদ্রলোক ও অফিস থেকে নেমন্তন্ন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন কিন্তু সঠিক ঠিকানা না থাকায় সেখানে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায় আর অতিথিরা ফিরে যান নিজের বাড়িতে।তাই বাড়ি ফিরে সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া করে আবারও বেড়িয়ে পড়েন অফিস অভিমুখে এক জরুরি আলোচনা করতে অধস্তন কর্মচারীদের সাথে।

আলোচনার বিষয়বস্তু হলো যে কোনো নেমন্তন্ন বাড়ি বা ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার এক সহজ পদ্ধতি বার করার অবিরাম প্রচেষ্টা।প্রথমে অনেকেই অবাক এমন উদ্ভট চিন্তাধারা শুনে, অনেকে হেসেছেন অনেকে বসের মন রক্ষার্থে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন। অবশেষে একদিন এই আপ্রাণ চেষ্টার তাগিদে লক্ষ্যের দিকে পৌঁছানো সম্ভব হলো। প্রথমে সাফল্য পায় আমেরিকায়, তারপর লন্ডনে,তারপরেই চরম সাফল্য সারা বিশ্বে। যার নামটা আমাদের সকলেরই জানা google navigation আর ভদ্রলোকটি আর কেউ নন সেই দক্ষিণ ভারতীয় আমার আপনার অতি পরিচিত গুগলেরিই কর্ণধার সুন্দর পিচাই।

Sundor pichai

গত ০৮/১১/২০২১ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে পুরস্কৃত হলেন ম্যাঙ্গালোরের কমলালেবু বিক্রেতা শ্রী হরেকালা হাজাব্বা,

Harekala Hajabba

উড়িষ্যা থেকে তুলসী গৌড়া, এনারাই হলেন আমার আপনার আসল হিরো কিংবা হিরোইন ,কোনো চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকা নন।জীবনের লক্ষ্যে কোনোদিন লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি বিশ্বাস টা করেছেন নিজের উপর। H C Verma নামটা হয়তো সর্বজনবিদিত এই মুহূর্তে ফিজিক্সের একজন দিকপাল মানুষ ও প্রশিক্ষক জীবনে চাইলে আয়েশের জীবন বহু আগেই কাটাতে পারতেন।উনি নিজেও পেলেন এবছরের পদ্মশ্রী পুরষ্কার।

Prof. H C Verma

বিদেশ উনাকে বহু আগেই হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন, যাননি কারণটা হয়তো একটাই যেটাই করবো দেশের জন্য সেটাই তো আসল জয় একথা তিনি অকাতরে স্বীকার ও করেছেন।উপরন্তু সুদূর MITর অধ্যাপক walter Lewin ভারতে এসেছেন শুধুমাত্র একটিবার H C Vermaর সাথে কথা বলবেন ও আলাপ করবেন।

Prof. Walter Lewin

এই Walter Lewin MIT র এমন এক অধ্যাপক যাঁর এক ভিডিও দেখে অনেকটাই স্তম্ভিত হই।ছাত্রদের পড়াচ্ছেন ও বোঝাচ্ছেন পেন্ডুলাম সম্পর্কিত বিষয় এক বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে। তাই নিজেকে দড়িতে শুইয়ে রেখে সমানে সামনে ও পেছনে এগোচ্ছেন দোল খাচ্ছেন আর ওই অবস্থায় একজন ঊর্ধ্বতন বয়সী মানুষ অনবরত তাঁর লেকচার দিয়েই চলেছেন। এযেন এক লক্ষ্যের সাথে বাস্তবের মেলবন্ধন দেখাচ্ছেন ছাত্রদের সম্মুখে।ঠিক এমনটাই তো হয়। তাই এমন স্থির লক্ষ্যের সফল মানুষগুলো অনেক কিছুই ভাবতে শেখান।

হয়তো ঠিক এই কারণেই উনি একজন MIT র মত সংস্থার বিশিষ্ঠ সম্মানিত অধ্যাপক।

লক্ষ্যের কাছে হয়তো বয়সটা নিতান্তই ছোট সেটা যেকোন বয়সেই হওয়া সম্ভব।পঞ্চাশ বছর বয়সে মহিলাদের প্রসাধনীর জন্য একটা ব্র্যান্ড সৃষ্টি করে নজির গড়লেন এই মহিলা। সংকল্পটা তৈরি হয়েছিল অনেক আগেই হয়তো চল্লিশের মাঝামাঝিতে। আর এই মুহূর্তে উনি প্রথম ভারতীয় বিলিওনেয়র মহিলা যিনি নিজস্ব ব্র্যান্ড NYKAA সৃষ্টি করেন এই মুহূর্তে তাঁর বয়স মাত্র ৫৮ বছর নাম falguni Nayyar ।

Falguni Nayyar

এই সমস্ত মানুষ থেকে একটাই শিক্ষা পাওয়া যায়- স্থির লক্ষ্যের দিকে এগোনোর চেষ্টা ও অবিরাম উদ্দীপনা।যেখানেই অনেক আয়েস,অনেক স্বাচ্ছন্দ্য,অনেক বেশি আরামপ্রদ সেটাই কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার মূল কারণ, সেটা আমরা কেউই হয়তো বুঝি না তাই আমরা সকলেই সাধারণ মানুষ। আমরা সর্বক্ষণই বেঁচে আছি whatsapp কিংবা ফেইসবুকে গুটিকয়েক ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে সেটাই জীবনের হয়তো আসল লক্ষ্যভ্রষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

satta king tw