BMV-39/9 ছোটবেলার ঘাটশিলা- নবম ভাগ (“চল কোদাল চালাই,ভুলে মানের বালাই, ঝেড়ে অলস মেজাজ হবে শরীর ঝালাই”)
শীতকালের দুপুর কিংবা রাত্রি সবসময় একটা ঠান্ডার অলসতা জেঁকে বসে, ঘাটশিলার শীত মানেই একটা হাঁড়কাপানো অনুভূতি। সকাল শুরু হয় লেপের থেকে বেরিয়ে দেরিতে আর রাত শুরু হয় ঘাটশিলার চারিদিকের নিস্তব্ধতায়, তাই হয়তো নিদ্রা দেবীর আগমন ও হয় তাড়াতাড়ি।যাক বাবার অফিস থেকে আসার বহু আগেই পৌঁছে গেছি এটাই রক্ষে। ফিরে এসে দিদিদের সাথে বসে পড়লাম অলস মেজাজকে চাঙ্গা করতে,আর শরীরকে ঝালাই করতে চোর পুলিশ খেলায় “পুলিস পুলিস চোর কো পাকরো”।
মা দিদিদের বললেন, কি রে আজ তো রান্নার বিশেষ কিছুই নেই, তাই খিচুরী ডিম অমলেট করি?অমনি আমি বললাম, যা ইচ্ছে করে করো। আমি আবারও খেলায় এই কাটিং পাড়ার চোর হয়েছি।এই জায়গাটা বাবা না ছাড়লে চোরের ভূতটা আমার মাথার থেকে বেরোবে না।দেখছো যখন থেকে খেলছি প্রতিবারেই চোর হচ্ছি।
বাবা অমনি হেসে বললেন – দেবু শোন তোর স্কুলের হেড মাস্টার বগলা কিঙ্কর মন্ডল কোথায় থাকে জানিস? আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনে মানে পরের গলিটাই, ওসবে বাবা কিছু হয় না।খেলে নে খেলে নে যত খুশি ,আর মাত্র একদিন পরেই তো তোর স্কুল দিদিদের কলেজ খুলছে, এরপর তো আর খেলতেই পারবি না।
আমি বললাম কি আর করার পড়াশুনো করে দেখছো তো “অপুর” কি অবস্থা বড় হয়েও চাকরি পেল না,আমারও না হয় তখন বিয়ে দিয়ে দিও।মা অমনি রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন ,পাছে আমি মুখ ফস্কে আরো কিছু বলে ফেলি, বিশেষ করে আজ ঘুরতে গিয়েছিলাম তাও আবার অফিসের গাড়িতে।
মা বললেন, আরে বাবা! তোর বাবা কি করে চিনবেন অপুকে ,আজ একজনের সাথে পরিচয় হলো তারই নাম অপু ,গামছা বিক্রি করে।বলতে বলতে মা এক নতুন গামছা বার করে বাবাকে দেখালেন।যাক মায়ের আর জনার্দন চাচার কোনো ভাবে মান রক্ষা পেল।
মা বাবা বললেন ,শোন পরশু থেকে প্রথম দিন স্কুলে যাবি তাও আবার নতুন জায়গা,তাই স্কুলে গিয়েই প্রথমে হেড মাস্টারকে পা ধরে প্রণাম করিস, স্যারেদের আশির্বাদ নিতে শেখ বাবা।
একদিন পর –
অবশেষে সেই প্রত্যাশিত দিন ফিরে এলো, সকালে উঠেই স্নান করে নতুন সাদা জামা, নীল হাফ প্যান্টটা পড়তেই রাগ ধরলো সেই মনোরঞ্জন কাকুর উপর কি প্যান্ট বানিয়েছে, এতো দেখছি একটা হাবিলদারের প্যান্ট হাঁটু অব্দি,ব্যস হলো এবারে হাতে একটা ডান্ডা দিয়ে দাও তাহলেই চলবে।মা বললেন আচ্ছা ঠিক আছে বাবা আজ পড়ে যা রবিবারে না হয় বাবা গিয়ে ঠিক করে দেবে।এক সপ্তাহ টানতে হবে তা বলে, নতুন বন্ধুরা কি বলবে?
তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে হাঁটতে দিদির সাথে।বাবা একটা খাঁকি রঙের পিঠের ব্যাগ এনেছেন যার বাইরের দিকটা দুটো বকলেস দেওয়া, বই খাতা যা কিনেছি সবই ঢুকিয়ে দিলাম তাতে।ছোট্ট স্টীলের টিফিন বক্স মা রুটি আলুভাজা দিয়ে দিলেন সঙ্গে একটা মিষ্টি।
বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখি মা পেছনের লোহার জানালা দিয়ে দেখছেন আর হাত নাড়িয়ে যাচ্ছেন সমানে।আমিও ঘুরে ঘুরে দেখছি যতদূর দেখা যায়, একটা সময়ে গাছের পাতায় ঢাকা পড়লো মায়ের হাত দুটো আর আমিও বড় রাস্তায় উঠে পড়লাম দিদির হাত ধরে।
স্কুলের সামনে বড় গেট, প্রথম পা পড়তেই দেখি বাম দিকে একটা বড় মাঠ আর সেখানেই একজন শিক্ষক হাঁটুর উপর ধুতি পরা, পরনে সাদা পাঞ্জাবি ছেলেমেয়েদের নাচ শেখাচ্ছেন।ব্রতচারী নাচ বেশ নেচে নেচে “চল কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই, ঝেড়ে অলস মেজাজ হবে শরীর ঝালাই” ,গানটা বেশ মনে ধরলো ব্রতচারী নাচ।
পরে জানলাম উনাকে সকলে শান্তিবাবু বলে ডাকেন, ভালো নাম শান্তি চরণ ঠাকুর।পাশেই একজন সাদা শাড়ি পরিহিতা বয়স্কা মহিলা তদারকি করছেন ছেলেমেয়েদের নাচের ছন্দ ঠিক হচ্ছে কিনা গানের সাথে। স্কুলে উনার পরিচিত নাম পিসিমনি, ভাল নাম স্মৃতিকনা মুখোপাধ্যায়।
প্রথম ভালো লাগা স্কুলে ঢুকতেই, কিন্ত প্রধান শিক্ষকের ঘরটা কোনটা একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলেন। দিদি আর আমি বাইরে থেকেই জিজ্ঞাসা করলাম ,স্যার আসতে পারি? স্যার বললেন, ভেতরে এসো ,তোমাদের তো ঠিক চিনলাম না।আমি বললাম, কি করে চিনবেন আমরা কদিন আগেই এসেছি ঘাটশিলাতে আজ প্রথম”
বলতে বলতে পা ধরে প্রণাম করলাম।দেখি পাশেই বসে আছেন আরেকজন ,চিনলাম না দাঁড়ি আছে,নিশ্চয় আরেক মাস্টার মশাই তাই তাঁকেও প্রণাম করলাম।উনারা বললেন ,থাক বাবা থাক, জীবনে আগামীদিনে প্রতিষ্ঠা পাও।এনার নাম শুভেন্দু মাধব সরকার আর প্রধান শিক্ষক বগলা চরণ মন্ডল।শুভেন্দু স্যার রেজিষ্টার দেখে আমায় বললেন তোমার ক্লাস ফাইভ বি , আর দিদির সেভেন এ।
বেরিয়ে পড়লাম ক্লাসরুমের খোঁজে, কোনটা আমার আর কোনটা দিদির ক্লাস রুম।স্কুলে ঢুকতেই ডানদিকের ক্লাস সেগুলো অনেকটা ইংরেজির L সেপের মত।ডানদিকে L এর ডগা থেকে শুরু করলাম আর শেষ যেখানে সেটাই দেখলাম আমার ক্লাস রুম একেবারেই শেষের রুমটা।দিদির ঘরটা আমার থেকে চারটে ঘর বাদ দিয়ে।ঘণ্টা পড়লো ছেলেমেয়েরা যে যার মত ক্লাসে ঢুকে পড়লো।
আমি নতুন, তাই ভাবলাম শেষের আগের বেঞ্চিতে বসি।পাশে তিনজন সহপাঠী। আমাদের ঠিক পাশের রো টা মেয়েদের।টিচার ঢুকলেন,পরনে ধুতি বেশ লম্বা রোগাটে গড়ন ,আমাদের ক্লাস টিচার হিন্দি পড়াবেন -নাম ভৈরব বাবু। আমি এক আপাদ মস্তক বাঙালি যুবক হিন্দি মোটেই জানিনা, অক্ষর জ্ঞান ও নেই,বলতে পারি তবে বেশির ভাগটাই বাংলা মেশানো।
শুরু হলো রোল কল, যেহেতু প্রথম দিন স্যার প্রত্যেকেকে তাই নামের সাথে রোল নম্বর টাও বলে দিলেন।সবাই দেখি দাঁড়িয়ে বলছে প্রেজেন্ট স্যার,আমার শেখা কথা পাকুরের পাঠশালা থেকে তাই দাঁড়িয়ে বললাম, উপস্থিত। আমি এভাবে বলাতে সহপাঠীরা তো হেসেই ফেললো, তখন স্যার আমায় ডেকে কথাটা শুধরে নিতে বললেন।
আমারই এক সহপাঠী ,একটু বেঁটে খাটো গায়ের রং প্রায় কালোই বলা চলে আমার প্রথম বন্ধু হলো- নাম আশীষ মাইতি।হয়তো অনেকে হেসেছে বলে তার খারাপ লাগলো, ব্যস এইথেকেই শুরু হলো আমার প্রথম বন্ধুর সাথে দীর্ঘ যাত্রাপথ।ঘুরে ঘুরে ক্লাস রুমটা দেখছি একপাশে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে, ফ্যানটা একটা ঘ ঘ করে আওয়াজ করেই চলেছে জোর নেই বিশেষ।
যেই টেবিলে বসেছি, দেখি হয়তো আগের দাদারা জ্যামিতি বক্সের কাঁটা দিয়ে খোদাই করে রেখেছে তাদের নাম।ভারী অদ্ভুত তো,মনে মনে ভাবলাম আদৌও কি কোনো প্রয়োজন আছে এভাবে নাম লেখার ?সম্পূর্ণ বেঞ্চটাতেই নামের এক খোদাই শিল্প।ফাইভ বি ক্লাসের পেছনের জানালাটাও ভারী চমৎকার ঢোকার দরজা থেকে প্রায় দুগুনের বেশি চওড়া।জানালায় কোনো শিক নেই।এই ক্লাস রুমেরই ঠিক পেছনে ছেলেদের বাথরুম।
তাই টিফিন টাইমে দেখি বেশিরভাগ ছেলেরাই জানালা দিয়ে বাথরুম যায় , ফেরেও সেই একই পথে।টিফিন হলো বাইরে দেখি কেউ সাইকেল চালাচ্ছে,কেউ টিফিন খেতে ব্যস্ত, মেয়েরা জমাট বেঁধে এক আড্ডায় বসেছে।কেউ বা চলেছে আমগাছ তলায় ঘুগনি খেতে।মেয়েদের একটাই টয়লেট ,অনেকটাই দূরে জুনিয়র ক্লাসের দিকে শিক্ষক রুমের পাশে, তাই হয়তো মেয়েরা একা যায় না একটা দলগত ব্যাপার আছে।
আমি নিজেও টিফিন বার করে খেতে লাগলাম আশীষকে নিয়ে, ও টিফিন আনেনি।শেষ হতেই ও বললো চল ঘুগনি খেয়ে আসি।আমি বললাম আমার তো পয়সা নেই ।আশীষ হাল্কা হেসে বললো কি হয়েছে আমার কাছে আছে চারআনা, তাতেই হয়ে যাবে। ঘুগনি বিক্রেতা কাকুর নাম দেবুদা , ” দেবুদার ঘুগনি” বিশেষ পরিচিত।একটা শালপাতার খালা একটা কাঠের চামচ,আশীষ বললো কাকু আরেকটা চামচ দাও।
একটা ছোট্ট প্রয়াস দেবুদার ঘুগনি নিয়ে বহু আগেই লেখা উনার সম্বন্ধে এক কবিতা। ক্লিক করুন এখানে :- http://sadamata101.blogspot.com/2020/07/blog-post.html
আমরা দুই বন্ধু একটা খালা দুটো কাঠের চামচ দিয়ে বড়ই তৃপ্তি করে খেলাম।শেষের ঝোলটা ভারী সুস্বাদু ইচ্ছে ছিলো আমিই খাই,পয়সা বন্ধুর তাই বললাম তুইই খেয়ে নে, তবে ঘুগনিটা কিন্তু ভারী সুস্বাদু।এখনও কিছুটা সময় আছে তাই আশীষ আমায় নিয়ে গেলো ভূতের ঘর দেখাতে।সাইকেল স্ট্যান্ডের পাশেই একটা সিড়ি উঠে গেছে দোতলায় ,সেটা নাকি বায়োলজির প্র্যাক্টিক্যাল রুম।
একটু ঠেলা মারতেই দরজায় একটা ক…ক …করে আওয়াজ হতেই ঢুকেই ডানদিকে দেখি এক বিশাল কঙ্কাল।ভয়ে গা শিউরে উঠলো আশীষ খুবই খুশি আমায় কঙ্কাল দেখাতে পেরে।
টিফিন শেষের ঘন্টা পড়তেই ছুটে গেলাম ক্লাসের দিকে। ক্লাস শুরু বাংলা ক্লাস, উনি ঢুকতেই হেড মাষ্টারের কাছ থেকে এক নোটিশ এলো একজন পিওন নিয়ে এলেন সেই নোটিশ। আজ আর ক্লাস হবেনা প্রথমদিন বলে তাই হেডমাস্টারের একটা ভাষণ সবার উদ্দেশ্যে, তার পরেই ছুটি।প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা বেশ মধুর তার সাথে একটা ভালোলাগার অনুভূতি। মন দিয়ে ফেললাম স্কুল টাকে, সঙ্গে সহপাঠীদের ও শিক্ষকদের একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব দেখে।
স্কুল ছুটির পর আবারো দিদি আর আমি বেরিয়ে এলাম ।আশীষ বললো আমার বাড়ি ফেরার পথটা উল্টো ,মানে পিছনের দিকে, থাকি লালডিতে।আমার বড্ড ইচ্ছে করলো দেখি কোন পথে আশীষ ফিরে যায়।দেখি ঠিক স্কুলের পেছনে একটা ছোট্ট গেট একসাথে একজনই বেরোতে বা ঢুকতে পারে তবে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় সেই গেট দিয়ে।
গেটের সামনে যেতেই দেখি বাইরেটা অর্থাৎ গেটের থেকে বেরোতেই একটা ধান ক্ষেত ছেলেমেয়েরা চলেছে সারিবদ্ধ ভাবে আল বিলের আঁকা বাঁকা পথ ধরে বাড়ির পথে। মাকে এসে কতদিন যে এই গেটের কথাটা বলেছি তার ইয়ত্তা নেই।প্রশ্ন একটাই ছিল “মা স্কুলের মেইন গেট টা তো কত্ত বড় স্কুল চাইলেই তো পেছনের গেটটা ভেঙে বড় করে দিতে পারে তাই না, কিন্তু কেন করে না?”
মা একদিন বললেন, শোন পড়াশুনো শিক্ষাদীক্ষার জায়গাটা হলো এমন, নিজেকে মাথা নত করার জায়গা সেখানে ঢুকতে হয় মাথাটা নত করে বেরোতেও হয় ঠিক একই ভাবে।সেদিনের সেই কথাটা বেশ মনে ধরেছিল আজ বুঝি মায়ের বলা সেই কথাটার মধ্যে কতটা যতার্থতা ছিল।সেই পথে হয়তো যারাই এসেছে আজ তারা বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠিত নিজের নিজের জায়গায়।
Click the link given below for next episode
http://www.blogmastersvoice.com/death-is-the-sound-of-distant-thunder-at-a-picnic/