BMV-39/10 ছোটোবেলার ঘাটশিলা- দশম ভাগ (গিরির পথ ধরে অবিরাম”শ্রাবণের ধারার মত….” ধারাগিরি, এ যে আমাদেরই নায়াগ্রা)
আজ রবিবার তাই বাবারও ছুটি। গতসপ্তাহ থেকেই মা মানসিক প্রস্ততি নিচ্ছিলেন, এমনিতেই শীতকাল তাই বিশ্বাসকাকুদের পরিবার ও আমরা যাবো চড়ুইভাতি করতে- ধারাগিরি।নতুন জায়গা দেখাও হবে আবার উপরি পাওনা চড়ুইভাতি।
সমস্ত আয়োজন আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন বাড়ির বড়রা। শুধু কিসে যাবো এটাই ছিল একটা দোটানা।সেই সময় গরুর গাড়ীর একটা চল ছিল তবে সময় বহুক্ষণ লাগে এটাই অসুবিধে।কাকু ঠিক করেছেন ঠিক সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই রওনা দেবো।
ফুলডুংরিকে বাম হাতে রেখে পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো আমাদের গরুরগাড়ী। রাস্তায় ঢাল আসলেই বোঝা যায় গরুগুলো সজোরে নেমে চলেছে সঙ্গে আমরাও।
মায়ের কোলকে বালিশ করে বিচালি পাতা বিছানায় কখনো চিত হয়ে আকাশ তো,কখনো উপুড় হয়ে সামনে আসা রাস্তা, গ্রাম এগিয়ে আসছে, অপরূপ এক অনুভূতি আজও যেন অনুভূতি ও উপলদ্ধিতে উঁকি মেরে চলেছে সেদিনের দৃশ্য ।
একটা সময় গ্রাম পেরোতেই এসে পড়লো দুপাশে ইউক্যালিপটাস গাছের এক সারিবদ্ধ জঙ্গল।লাল মাটির রাস্তা আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। তারই মধ্যে কিছু ছোট ছোট গাছও আছে, বাবা বললেন ওগুলো বনবিভাগের তত্বাবধানে আছে তাই এত গাছের সারি।
ট্রেনে ঝাড়গ্রাম কিংবা রাস্তাপথে লোধাশুলির জঙ্গল পেরোলেই সব খানেতেই এই একই প্রজাতির একটা সারি দেখতে পাওয়া যায় , হয়তো এখানকার আবহাওয়া ও মাটি এই ইউক্যালিপটাস গাছের জন্য উপযুক্ত।
একটা সময় গরুর বিশ্রামের ও খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত চালক আর সঙ্গে মা কাকিমাও ব্যস্ত টিফিন পরিবেশনে। গোল বান পাউরুটি মাঝে একটা ছোট্ট মোরব্বা,সঙ্গে কলা, মিষ্টি আর সেদ্ধ ডিম।জঙ্গলের মাঝে একটা শতরঞ্জি পেতে গোল করে ঘিরে সকালের নাস্তা বলা যেতে পারে।এটা বিহার বা ঝাড়খন্ডে খুবই প্রচলিত এক শব্দ।
ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই আবারও রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের পথে।বেশ খানিকটা যেতেই চোখে পড়লো একটা বিরাট আকারের জলাশয় জায়গার নাম বুরুডি।এক শান্ত গ্রাম লোকজন নেই বললেই চলে, আমরা বুরুডির প্রাকৃতিক শোভা নিতে নিতেই চললাম ধারাগিরির পথে।
এই জায়গাটা ভারী চমৎকার শান্ত নীলাভ জল অনেকদূর অব্দি আর সেটা শেষ হতেই পাহাড়।জঙ্গল পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই বুরুডি।যেই জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে ডানদিকেই পাহাড়।এই প্রথম পাহাড় দেখলাম খুবই কাছ থেকে। শীতের সকালে যখন বুরুডির প্রাকৃতিক শোভা উপলব্ধি করছি কাছের থেকে, ওমনি গ্রামের কিছু কচিকাচার দল আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো।
তারাও তো একই জিনিষ উপলব্ধি করছে ,এনারা কারা , কেনই বা এসেছে? যা দেখছে এটা তো স্বাভাবিক এক গ্রামবাংলার পটভূমি।আমাদের দু একটা স্বভাবচিত বরাবরের জিজ্ঞাস্য কথা কোথায় থাকিস?তোর নাম কি? কোন কথার উত্তর দেয়, আবার কোনো কথার উত্তর দেয় না।হাত টা উঁচিয়ে বলে ঐ পাহাড়টা পেরোলেই আমাদের গ্রাম।
একটা বাচ্চা নাম মতি, বড়দিদির ভারী পছন্দ হোলো নামটা। দিদি আমায় খুঁজে চলেছে আমার আরো শিশুকালকে মতির সাথে। নাক দিয়ে নিসৃত অবারিত ধারা শুকিয়ে ঠোঁট অব্দি জমাট বেঁধেছে ,কিছুই এসে যায় না মতির।আমাদের দেখিয়ে বললো আমার দুই বোন জ্যোতি, ও সতী। হয়তো বোঝাতে চেয়েছে তোমাদের মত আমরাও ভাই বোন নিয়ে আনন্দে থাকি।
আমরা বুঝছি আর দেখেই চলেছি তাদের হত দরিদ্র অবস্থার চালচিত্র।দেখার তফাৎ হয়তো দুজন দুজনার এতটুকুই। বুরুডি একপ্রকার চোখ বুলালাম আর গন্তব্য ধারাগিরি। বাচ্চাগুলোও আমাদের সহযাত্রী হলো সে পথেই যেহেতু তাদের গ্রাম। গরুগাড়ীতে উঠতে বললাম তারা আপত্তি জানালো বললো আমরা হেঁটেই যাবো।কিছুটা যেতেই দেখি তারা গরুরগাড়ীর পেছনে ঝুলতে ঝুলতে চললো।আমারও ভারী আনন্দ হলো তাদের এই খেলায় তাই গাড়ি থেকে নেমে নিজেও যোগ দিলাম
ঝোলার মত এক অপূর্ব খেলায়।সামনেই রাস্তাটা ঢালু তাই গরুরগাড়ী ও ছুটলো একটা গতি নিয়ে আর আমি ঝুলতে ঝুলতে হাত ফস্কে পড়ে গেলাম ধুলো ভর্তি রাস্তার পথে।আমায় ওভাবে পড়তে দেখে মতির ভারী আনন্দ তাই সে বোনদের নিয়ে আমায় আরো ধুলো ছড়িয়ে দিল সারাটা গায়ে ,এ যেন ধুলোর দোল উৎসবে আমি মেখে উঠলাম সারাটা শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
গরুর গাড়িতে বাকি সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে তাই জানেই না আমার এমন হাল। একটা সময় মতি ও তার বোনেরা আমায় ঝেড়ে দিল সমস্ত ধুলো এটাই তো ওদের গ্রামবাংলার খেলা এখানেই যে আনন্দ লুকিয়ে আছে তাদের। আমি তাদেরকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে গেলাম গরুর গাড়ীর দিকে, মা তো অবাক আমার এই হাল দেখে।উঠে পড়লাম গরুরগাড়িতে কিছুটা বিশ্রাম নিতে।মতি ও তার দুই বোনেদের সঙ্গে ছুটলো আগে আগে জঙ্গলের দিকে ,কিছুটা এগোতেই একটু থমকে দাঁড়ালো।
দেখি কিছু একটা দেখে কি কি সব বলেই চলেছে পুটুস গাছের সামনে দাঁড়িয়ে।আমায় ডাকতে আমিও ছুটে গেলাম, পেছন পেছন দিদিরাও ,দেখি গাছের ঝোপে লুকিয়ে আছে এক বহুরূপী রঙধারি গিরগিটি।দেখে খানিকটা হলেও ভয় পেলাম, শিউরে উঠলো গোটা শরীরটা।রং পাল্টাচ্ছে সমানে কখনো লাল ,কখনো সবুজ,মুহূর্তে মুহূর্তেই রং বদলাচ্ছে আকারেও বেশ বড়।
চোখের পাতা বন্ধ করলে ঢাকনার মত বন্ধ করে দিচ্ছে।পিঠের দিকটা বেশ কাঁটা যুক্ত।দেখলাম মতির বিশেষ ভয় নেই সে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে তাতেই দিদি চিৎকার করে উঠলো “এই মতি কি করছিস কামড়ে দেবে তো, তোর গায়েই লাফিয়ে পড়বে”। মতি নির্বাক হয়ে হাসলো শুধু আর বললো” আমাদের গাঁয়ের লোক হৈলে ক্যাকলাসটাকে (গিরগিটির নাম স্থানীয় ভাষায়) গুলাটি দি (গুলতি)করি মাইরে কখন সাফা কইরেন দিতো”।
পথে আমাদের পথ চেনাতে চেনাতে চলেছে মতি ও তার দুই বোন- ধারাগিরির পথ। দুই খানা পাহাড় পেরোতে হয় তারপর আরেক পাহাড়ের গোড়ায় আমাদের দেশীয় নায়াগ্রা প্রপাত। বুরুডির থেকে দূর আছে ,আনুমানিক দুই কিলোমিটারের থেকে কিছুটা বেশি।দ্বিতীয় পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই মতিরা এগিয়ে গেলো সামনে “টুকু দাড়াও উটা হাতি আছে কিনা জঙ্গলে দেইখেই সামনের দি করি আগাবেক ,হাতির পায়খানা থাকলেই বুঝবে উরা জল খাইতে আসছেক সামনের বাঁধে”।
মতি সবুজ সংকেত দিল আর আমরা এগিয়ে চললাম। পাহাড় শেষ হতেই পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে একটা সমতল জায়গা আসতেই মতি বললো “গরুর গাড়ি আর সামনে যাবেক নাই হাটি করি যাইতে হবেক উ দেখা যায় ধারাগিরি, আর উ ঘরটায় আমরা থাকি”।নেমে পড়লাম সকলে মতির সাথে, হাঁটাপথে চললাম ধারাগিরির দর্শনে।
চতুর্দিকে পাথর আর পাথর, অবশেষে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে গাছের শাখাপ্রশাখা ,সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সামনেই দেখি পাহাড় বেয়ে পড়ছে জলধারা। হয়তো অনেকদূর থেকে বয়ে আসা জল এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় হয়ে বয়ে আসছে।একেবারে পরিশ্রুত জল, জলের নিচে পড়ে থাকা ছোট ছোট নুড়ি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। উপরের দিকে তাকাতেই দেখি সূর্যের ছটা গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে।
মা বললেন এবারে সবাই চল আগে রান্নার দিকটা দেখি ।প্রায় এগারোটা বাজে তিনটের মধ্যেই রওনা দিতে হবে ,পথে যদি সত্যি সত্যিই হাতির পাল্লায় পড়ি তাহলে এখানেই জীবন শেষ।বেরোনোর আগে আরেকবার এসে না হয় দেখে যাবো।
ফিরে এলাম ,মতি দেখি ততক্ষনে তার বাবা মাকে নিয়ে এসে হাজির।বাবা মতির বাবাকে কি করেন জিজ্ঞেস করতেই সে বলে এই সামান্য জমি আছে তাতেই কোনোভাবে চাষাবাদ করি, আর জঙ্গলের কাঠ কেটে সেটা ঘাটশিলাতে গিয়ে বিক্রি করি, কোনো ভাবে চলে যায়।মতির মা সড় মাহাতো,সে দেখি রান্নার কাঠ নিয়ে এসে হাজির যদিও কাকিমা বললেন আমাদের স্টোভ উনান সবই সঙ্গে আছে।
সড় ও বললো কাঠের রান্না আর মাটির হাঁড়িতে একবার খাইয়ে দেখো, খুব ভালো রান্না হয়।মা কাকিমারা রাজিও হলেন সড় এর কথায়। ঠিক হলো মতিদের পরিবারও খাবে আমাদের সাথে কিন্ত মাংস তো কম ,মা বললেন হয়ে যাবে কি আর করার আমরা না হয় একটু কম খাবো।দুপুরের রান্না প্রায় দেড়টার মধ্যেই শেষ। মতি বাড়ির থেকে দৌড়ে নিয়ে এলো বাতাবি লেবুর উপর নেকড়া জড়িয়ে ফুটবল ,আগে সেভাবে খেলা হয়ে ওঠেনি।
একটা সময় মনে হলো যেন মতিই আমার হারিয়ে যাওয়া বাসু, বিমল -আবারও ফিরে পেলাম কিন্ত এটা যে মুহূর্তের, পিকনিক শেষ হলেই তো চলে যাবো।আমরা রওনা দিতেই মতি ও তার বোনেদের চোখ প্রায় ছলছল করছে কিছুতেই ছাড়তে চাইছেনা আমাদের, আমারও একই অবস্থা।মনে হচ্ছে মতি যদি সারাটা জীবন আমার সাথে থাকতো কি ভালোই না হতো।আমরা হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় পেরিয়ে এলাম, মতি ও আমাদের সাথে ধারাগিরি পর্যন্ত এলো।
গরুর গাড়িতে ওঠার আগে জাপটে ধরলাম মতিকে , এ যেন সারাজীবনের বন্ধু বিয়োগ।আর হয়তো কেন, কোনোদিনও মতির সাথে দেখা হবে না ,কেনই বা বাবা মা নিয়ে আসবেন এত দূরে।উঠে পড়লাম সামনেই ঢালু রাস্তা মদন চালক গরুর লেজ ধরে হেটহেট করতেই গরুর গাড়িটা সজোরে নেমে এলো নিচের দিকে মতি তখনও দাঁড়িয়ে হাত নেড়েই চলেছে। আমি ও একপ্রকার তাই করছি ,যতদূর দেখা যায় মতিকে হাত নেড়েই চলেছি সঙ্গে তার দুই বোন জ্যোতি ও সতী।
সারাদিন ক্লান্ত বাড়িতে এসে ঘুমোতে চাইলেও ঘুমোতে পারছি না, থেকে থেকেই মতির জন্য মনটা কেঁদে উঠছে। ভাবছি মতিও নিশ্চয় আমার জন্য মন খারাপ করছে ,হয়তো এখনো ঘুমায় নি মতি। গ্রামের অন্ধকার তাড়াতাড়িই নেমে এসেছে আর মতি পোয়াল বেছানো গদিতে মা বাবা বোনেদের সাথে শুয়ে শুয়ে ভেবেই চলেছে কয়েকঘন্টার সারাদিনটার অনুভূতিটা কেমন ছিল বন্ধু দেবুর সাথে।
অনেকটাই বড় হয়ে উত্তমকুমারের একটা সিনেমা দেখেছিলাম নামটা মনে পড়ছে না সেখানে একটা ডায়ালগ ছিল “আমাদের জীবনটা অনেকটাই ট্রেনে একসাথে পথ চলার মত কেউ কাউকে চিনি না।আলাপ হলো একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে না উঠতেই গন্তব্য আসতেই পরের স্টেশনে নেমে পড়া তারপর সবই শেষ, ভুলে যাওয়া”।এই কটা লাইন উত্তমকুমার যখন বলছেন সিনেমায় কেন জানিনা মন খুঁজে চলেছে তখন মতিকে, চোখের পাশে অবিরত “ধারাগিরি” বয়েই চলেছে।
একবার শুধু একবার যদি আবারও দেখা হতো মতির সাথে। সত্যিই ঠিক এমনটাই তো হয় পথচলতি ট্রেনে আলাপ হওয়া মানুষের সাথে, কারোর ক্ষেত্রে কদাচিৎ দেখা হয় ,সেটাও আবার অঘটনে হয়তো মনের টান মতির মত ভালোবাসার মানুষ পেলে।মতি ছিল সত্যি কারের আমার কাছে এক অমূল্য মতি এক ভালোবাসার স্মৃতিতে, হারিয়ে গেছে সেই টুকরোটা।