school sports

BMV- 39/11ছোটোবেলার ঘাটশিলা – একাদশ ভাগ (“উটা বিহা হবেক সেও আর বুনিয়ার বিহা” সঙ্গে বস্তা,বিস্কুট আর পাশবালিশ নিয়ে বার্ষিক দৌড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা)

আজ সোমবার ছন্দে ফিরতে হলো গতকালের ধারাগিরির “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের” নিরাশা নিয়ে একেবারে বাস্তবে।স্কুলে দেরি হয়ে গেছে পা রাখতেই ঘণ্টা বেজে উঠলো অসিতদার ঢং ঢং ঘণ্টার আওয়াজে ছুটলাম পড়ি কি মরি করতে করতে ক্লাস রুমে।

ভৈরব স্যারের রোল কল শেষেই একজনকে বললেন একটা কাহিনী পড়তে সে পড়েই চলেছে একটা সময় থামতে বললেন।হঠাৎ দেখি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এতক্ষণ যা শুনলে খুবই সহজ এক প্রশ্ন করি বোলো  “বন্দরগাহ কিসে কহতে হে?”

আমি তো অবাক একেবারেই নির্বাক নিশ্চুপ এই প্রথম শুনলাম এই শব্দটা তাও আবার হিন্দিতে।মুখে কোনো উত্তর নেই আমি ভাবছি কি বলি। একটা সময় দেখলাম ধুতি পরিহিত এই শিক্ষক প্রায় দুটো পা তুলেই দিলেন নিজের বসার হাতলওয়ালা চেয়ারের উপরে। মাথাটা একহাতে ভর করে তেরছা ভাবে বসে হাতে ছরি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর সমানে নিজের কাঁচা পাকা ভুরু যুগল কাপিয়েই চলেছেন।বুঝতে পারছি না হাসবো নাকি গম্ভীর থাকবো।

একটা সময় উনি বেশ ইসৎ হেসে আমায় বললেন “ক্যা যাহা শ বন্দর রহতে হে বলিয়ে না উসী কো বন্দরগাহ কহালাতা হে”।আমি ভাবলাম হয়তো ঠিকই বলছেন আমার তো জানা নেই।মাস্টার মানুষ ভুল কিছু নিশ্চয় শেখাবেন না। দিলাম সম্মতি জানিয়ে ইয়েস স্যার বলে।ভাবলাম বসতে বলবেন অমনি আমি নিচু হতেই দূর থেকে ছুড়লেন শেষ হয়ে যাওয়া চকের অর্ধেক টুকরো।

ব্যথা পেলাম হয়তো আমার প্রতি কিছুটা কষ্ট হলো তাঁর তাই সামনে ডাকলেন।বলেন “ব্যাটা ইতনা আসান শাওয়াল আপকো নেহি আতা” আমি কাচুমাচু সুরে বললাম ” স্যার আপ যো কহতা ,আমি মোটেই বুঝিনা” আমার হিন্দী শুনে সহপাঠীরা তো হো হো করে উটলো।

যারা হাসলো তাদের প্রত্যেককেই স্যার দাঁড় করালেন ও এক গুরুদায়িত্ব দিলেন আমায় হিন্দী শেখাতে।আমার বসার বেঞ্চের পাশেই একটি মেয়ে দেখি এগিয়ে এলো আমায় শেখাতে নাম গুলাবি মাছুয়া।নামটা ভারী সুন্দর গুলাবী সত্যিই সে গোলাপী রঙের গায়ের রং কিন্ত উপাধিটা মাছুয়ার আবার কিসের প্রয়োজন ছিল বাবা।

জানুয়ারী মাস সামনেই সরস্বতী পুজো তাই স্কুলে চলছে একটা তোড়জোড় কিভাবে ভালো করে পুজোটা সম্পন্ন করা যায়।স্কুলের মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই প্রথম যে ঘরটা ওটা ক্লাস টেনের ক্লাস হয় ঘরটা আকারে বড়।প্রতিবছর নাকি এখানেই সরস্বতী পূজো হয়।জানালা দিয়ে তাকেতেই দেখি স্কুলে ঢুকছে বসার জন্য স্তুপাকৃতি কাঠের চেয়ার সঙ্গে বিশাল বিশাল কালো লোহার কড়াই,আর রান্নার জন্য হাতা খুন্তি।

এতসব কি হবে কি খাওয়ানো হবে মনে এক কৌতুহল আর আনন্দ ঘিরে। টিফিন টাইমে সেই কড়াই দেখতে গেলাম ঘুরে ঘুরে দেখেই চলেছি কড়াই আবার কখনো চেয়ার নিয়ে বসছি একটু পুজোর আমেজ আনতে।

একজন বললো এই কড়াই দিয়ে বোঁদে তৈরি হবে সাথে সেও দেবে। তাতে আরেক সহপাঠী আদিত্য সিট কানের সামনে মুহূর্তে বলে চলে গেলো “উটা বিহা হবেক সেও আর বুনিয়ার বিহা” কথাটা বেশ মজার ও মনে  ধরলো।

টিফিন টাইম শেষ হতেই ক্লাসে গিয়ে বসলাম নতুন শিক্ষক বাংলা পড়াবেন পরমানিক স্যার।রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা পড়াতে শুরু করলেন।এমন সময় দেখি উঁচু ক্লাসের দাদারা ও কিছু শিক্ষক একে একে ক্লাস রুমে প্রবেশ করলেন। প্রত্যেককে দুটো করে কুপন দেওয়া হলো একটা বোঁদের জন্য আরেকটা সেও এর জন্যে।

বেশ যত্ন করে রেখে দিলাম সেই কুপন অঙ্ক খাতার ভিতরে।মাঝে মাঝেই দেখছি ঠিকঠাক আছে কিনা।আশীষ পাশ থেকে বললো ওটা সাবধানে রাখিস খুব কুপন চুরি হয় স্কুলে, ওটা হারালে সেও বোঁদে চাইলেও আর পাবি না।আমি বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে যত্ন করে রাখতে বললাম।

বিকেলে ধোপা এসেছে বাড়িতে কাপড় দিতে, মা বাবার দেওয়া জামাকাপড়ের কুপনটা ধোপাকে না দিয়ে বোঁদের কুপনটা দিয়ে ফেলেছেন। আর সে নিজেও সেটা না দেখে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন সেটা পরে জানতে পারলাম। মনে খুবই দুঃখ যা আর বোঁদে পাওয়া হলো না।

পরদিন স্কুলে যেতেই দেখি আশীষ একটা বস্তা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। আমি জিজ্ঞ্যেস করতে সে বললো ওটা দেখতে পাবি টিফিনের সময়ে।সামনেই স্কুলের স্পোর্টস তো তাই একটা প্র্যাকটিসের বিশেষ প্রয়োজন আছে।

টিফিন হতেই আশীষ ছুটলো মাঠে আমিও ছুটলাম পেছন পেছন দেখি কি করে। দেখি আশীষ নিজেকে বস্তার ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে একে তো বেঁটে তাই দূর থেকে ওকে দেখায় যাচ্ছে না।টিফিন শেষে জানালাম আমার কুপন দুঃখের কথা।

পরের দিন সরস্বতী পূজো আমরা ছেলেরা সকাল সকাল স্কুলে গেলাম দেখি বাটোব্যাল স্যার পুরোহিত পূজো করেই চলেছেন শেষ আর হয় না।স্কুলের দাদারা লাল নীল কাগজ কেটে সেগুলো ত্রিভুজাকৃতি করে একটা লম্বা সুতলি দিয়ে স্কুলের গেট, ক্লাসরুম, পুজোর জায়গাটা ফ্যানের সাথে লাগিয়ে সাজিয়েই চলেছে।

এদিকে “সেও আর বোঁদের বিয়েতে” অংশ নিতে পারবো না বলে মনে ভারী দুঃখ।দূরে প্রাইমারি স্কুল তার পাশেই টিচার্স রম সেখানের জানালা দিয়েই দেওয়া শুরু হয়ে গেছে প্রসাদ।দূর থেকে দেখছি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে সেও আরেকটা প্যাকেটে বোঁদে নিয়ে ছেলেমেয়েরা আসছে মাঝমাঠের দিকে।

সেগুলোকে একসাথে মিলিয়ে তারা খাওয়াও শুরু করে দিয়েছে কেউ কেউ।শীতকালের দুপুর দেখে মনে কষ্ট আর মায়ের প্রতি রাগ ও হচ্ছে। একটা সময় ভাবলাম ধোপা কাকু নিশ্চয় পেয়েছে সে কুপন তক্কে তক্কে আছি যদি দেখিনা আমার কুপন নিয়ে লাইন দিয়েছে তাহলে খপাত করে গিয়ে ধরবো। আশীষ দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে আর সমানে বলে চলেছে একটার পর একটা উপায়।

অবশেষে হেড মাস্টারের ঘরে গিয়ে আসল সত্যি টা বলেই ফেললাম। উনি দেখি কাউকে ডেকে আমায় আবারও দুটো কুপন দিলেন।আনন্দ লেগেছিল সেদিন মনে হচ্ছিল অলিম্পিকে সোনার মেডেল পেয়েছি।ছোট ছোট আনন্দ তাতেও যে কত মজা আছে আজ সেটা অক্ষরে অক্ষরে বুঝি।

তবে এটা ঠিক সেও ও বোঁদের একসাথে খেতে আজও দারুন লাগে।বহুদিন দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারের পাশের দিনানাথের দোকান ঐ একই সেও বোঁদে খেয়েছি তবে তেলের একটা গন্ধ ছিল।ছোটবেলায় ওটাই স্বাভাবিক মনে হতো। ভাবতাম বোঁদে মানেই একটা গন্ধ ওটা না থাকলে ঠিক বোঁদে বোঁদে বলে মনে হয় না।

বেশ কিছুদিন পরেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা:-

স্কুল সেজেছে এক নতুন রূপে সম্পূর্ণ স্কুলের মাঠ খড়ি মাটি দিয়ে দাগ কাটা।একদিকে মাইক বাজছে তো আরেক দিকে হাটুই স্যারের হুইসেলের আওয়াজ সারাটা মাঠ কাঁপছে।একশো মিটার, দুশো মিটার দৌড়। রীলে রেস,বাচ্চাদের কমলালেবু আর বিস্কুট নিয়ে দৌড়, স্লো সাইকেল নিয়ে কেরামতি, দিদিমনিদের হাঁড়ি ভাঙ্গা প্রতিযোগিতা, থ্রি লেগ দৌড়।প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজেতা কে ধরার জন্য দিদিমণিরা দাঁড়িয়ে আছেন।

প্রসঙ্গত এই থ্রি লেগ প্রতিযোগিতায় আশীষের চাপে পড়ে আমি নিজেও নাম দিয়েছিলাম সেকেন্ড হয়েছিলাম আমরা। যদিও জিতের কৃতিত্বটা সম্পূর্ণ আশীষের। আশীষ দুই পায়ের মাঝে একটা ছোট্ট পাশবালিশ বানিয়ে নিয়ে এসেছিল যাতে আমার বাঁ পাশের গোড়ালি আর আশীষের ডান পায়ের গোড়ালিতে যেন ব্যথা না লাগে।

পাশবালিশের কাজ ছিল এতটুকুই।ওটা দুপায়ের মাঝখানে রেখে নেকড়া বা পট্টি দিয়ে শক্ত করে বাঁধতে হতো।আশীষের বাঁ পা আমাদের দুজনের জোড়া দেওয়া ডান ও বাঁ পা আর আমার নিজের ডান পা তাই এই খেলাটার নাম থ্রি লেগস।

সমস্ত খেলা শেষ হতেই প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেলো তাই কিছুক্ষণের একটা বিশ্রাম। বিশ্রামের পড়েই শুরু হলো শিক্ষকাদের হাঁড়ি ভাঙ্গা প্রতিযোগিতা।ছায়া দিদিমণি,কবিতা দিদিমণি,নমিতা দিদিমণি এনারা একে একে এলেন চোখ বন্ধ করে কত নিখুঁত ভাবে হাঁড়ি ভাঙ্গা যায়। এখেলা শেষ হতে না হতেই শুরু বহুরূপী সাজের খেলা মানে “গো এস ইউ লাইক” ।

প্রায় সমস্ত ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই অংশ নিয়েছে এই খেলায়। কেউ ভিখিরি তো কেউ পণ্ডিত,কেউ বা কুষ্ঠ রোগী সঙ্গে একজন গাড়ি ঠেলার লোক, আবার আরেকজন নেতাজি ,তো আরেকজন গান্ধীজি।এই খেলায় জাজ ত্রিপাঠী বাবু ও স্কুলের সেক্রেটারি।অন্ধকার নেমে এসেছে প্রায় শেষ খেলা মিউজিক্যাল চেয়ার একমাত্র শিক্ষিকারা ও ছাত্রীরা অংশগ্রহণে।

দিনের সমাপন হলো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান দিয়ে ও শান্তি বাবুর ব্রতচারী নাচ দিয়ে।মেয়েদের মধ্যে সবথেকে বেশি পুরস্কার বিজেতা প্রভাতী সিট, ও খুগলি দি।পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ঢুকছি এমন সময় দেখছি পাশের জঙ্গলে উঁকি মারছে ধুলোয় মেশানো আমার হারিয়ে যাওয়া নিমন্ত্রণ কুপন”সেও ও বোঁদের বিয়ে”।কুড়িয়ে নিয়ে মনকে বললাম ইসস পুজোর দিন যদি পেতাম তাহলে সবই ডবল ডবল খেতাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *