BMV-39/12 ছোটোবেলার ঘাটশিলা- দ্বাদশ ভাগ (তেজস্ক্রিয়তার আরেকনাম জাদুগোড়া,আকরিকের খনি মুসাবনি,সুবর্ণরেখায় বয়ে যাওয়া সোনা, এ যেন “একই অঙ্গে এত রূপ” শুনিনি তো আগে?
একদিকে যেমন বিভূতিভূষণ তাঁর অনবদ্য লেখায় পৃথিবীময় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সেই পথের পাঁচালী লিখে,তেমনটাই ঘাটশিলা থেকে মাত্র 18.6 কিলোমিটার দূরত্বে তেজষ্ক্রিয়তার খনি জাদুগোড়া আজ পৃথিবীখ্যত নাম। এ যেন সংস্কৃতি ও শিল্পকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দুই দিকপাল ঘাটশিলাকে ঘিরে।কে বলতে পারে হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে যেই তেজষ্ক্রিয় বম্ব উৎক্ষেপণ হয়েছিল তার ব্যবহার ও কার্যক্ষেত্রে আসল আতুর ঘর ছিল এই জাদুগোড়ায়?
আমার দেখা ছেলেবেলায় যেখানে আপনাদের সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম মৌভান্ডারের ব্রিজ দেখাতে ঠিক এরই কয়েকধাপ পিছিয়ে কোনো এক এপিসোডে আজ নিয়ে যাবো ব্রিজ পেরিয়ে পরবর্তীটুকু সেই তেজষ্ক্রিয়ের দেশে।
ব্রিজ পেরোতেই সোজা কিছুটা যাওয়ার পরেই রাস্তা উপরের দিকে উঠতে লাগলো প্রায় অনেকটাই তাই রাস্তার ওপারটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওপরে উঠতেই কালো সর্পিল রাস্তা এঁকেবেঁকে একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোতেই বাম হাতে পড়লো জঙ্গল ঘেরা স্কুল সামনে মস্ত উঁচু পাঁচিল নাম সুরদা সেন্ট্রাল স্কুল।
শীতকালে আসলে চোখে পড়বে মহুয়া ফুলে সারাটা রাস্তা সাদা হয়ে গেছে আর গ্রামের আদিবাসী মহিলারা সেই ফুল কুড়িয়ে নিয়ে চলেছেন নেশার দ্রব্য বানাতে।গরম কালে আসলে তো কথাই নেই পলাশের পর পলাশ বন।লাল পলাশে ঢেকে গেছে যেমন রাস্তা তেমনই জঙ্গল।মন উতলা হয়ে মাতাল করানো সেই বিখ্যাত গান কথা দিচ্ছি গাইতে ইচ্ছে করবে “তুই লালপাহারের দেশে যা রাঙা মাটির দেশে যা হিথাক তোকে মানাইছে না রে, হিক্কিবারে মানাইছে না রে” গানটার স্রষ্ঠা কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী হয়তো নিশ্চয় কখনো না কখনো এই পথেই এসেছিলেন আর শ্রীরামপুর স্টেশনের পাশে একই পলাশ গাছ দেখে লিখে ফেলেছিলেন সেই গান “হিথাক তোকে মনাইছেনা রে”।
যাক সে কথা আরেকটু এগোতেই সুরদা মোড় হাতছানি দিচ্ছে কোন পথে যাবেন বামদিকে গেলে আকরিকের খনি মুসাবনী, আর ডানদিকে গেলে তেজস্ক্রিয়তার খনি জাদুগোড়া। তাই প্রথমেই চললাম জাদুগোড়া ফিরতি পথে মুসবনি। এই রাস্তায় কিছুটা এগোতেই দুপাশে ঘনও জঙ্গল একেবারেই জনমানবহীন।
ড্রাইভার কাকু বললেন এইখান থেকেই মাইনস শুরু প্রায় পুরোটা জাদুগোড়া জুড়েই।একেবারে মাটির নিচে এক অন্য সাম্রাজ্য সেটা আলফা, বিটা,গামা রে সমানে ছুটোছুটি করে চলেছে নিজের নিজের শক্তি নিয়ে।এক অদেখা শক্তি কিন্ত সেটা হাঁড়হিম করে দেওয়া একটা উৎস মুহূর্তে মানুষের শরীরে ভেদ করে দেওয়া শক্তি জীবন মুহূর্তে ওলটপালট করে দিতে পারে।
গাড়ি চললো এসে দাঁড়ালাম ঠিক UCIL (ইউরেনিয়াম করপোরেশন ওফ ইন্ডিয়া লিমিটেড) এর গেটের সামনে।সাধারণের ঢোকা নিষেধ।বাইরে প্রহরায় দাঁড়িয়ে আধা সামরিক বাহিনী অর্থাৎ সেন্ট্রাল ফোর্স। আমাদের সঙ্গে থাকা আরেক কাকু উনি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন হঠাৎ বললেন ভাবতেও কেমন অবাক লাগে এই ইউরেনিয়াম থেকে বের হওয়া আলফা,বিটা,গামা রে একটা সময় রূপ নেই বেরিয়াম ও ক্রিপটনে।
এমন এক জায়গা সত্যিই বিস্ময়ের। শুনলাম বছরে নাকি এক চামচ উত্তোলন হয় এই জাদুগোড়া মাইনস থেকে আর ক্ষমতা হয়তো সাড়া পৃথিবীকে শক্তি দিয়ে যেতে পারে বেশ কিছু বছর ধরে।একজন স্থানীয় লোক বললেন আমাদের গ্রামের কোন লোক যখন একবার এই খনিতে ঢোকে তার গড় আয়ু নাকি আনুমানিক দশটা বছর কম হয়ে যায়।
তাই তাকে কারখানার কর্তপক্ষ বন্ড সাইন করে ঢোকান আর বদলে দেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।মনে মনে ভাবলাম আমি আজও ছোট তাই এই জায়গায় আবারও আসবো একটু বড় হয়ে পড়াশুনো করে তবেই। এতটাই বুঝলাম এ এমন জায়গা সেখানে পড়াশুনোর মাধ্যমে জানতে পারলে তবেই এই জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধুই উপলব্ধিতে আনতে পারা সম্ভব এমন শক্তিকে।