BMV-7/4 রুটি কলা থেকে বেড়ে ওঠা লালন- চতুর্থ ভাগ
জীবনে সামান্য কিছু আনন্দে যে আমার উচ্ছাস হতে পারে, ওটা ভাবি না,মনে মনে ভয় হয় এই তো পরোক্ষনেই এতটাই তলিয়ে যাবো তাতেই সমস্ত উচ্ছাস চাপা পড়ে যাবে । তবে হ্যাঁ, যেদিন পরপর আনন্দ এসে আমায় ধরা দেবে সেদিন বুঝবো আমাকে হয়তো ফিরতে হবে না ঐ সংগ্রামী দিনগুলোতে। সেদিন মনে রাখবো সন্তর্পনে অনেক গভীরে ক্ষত দাগের দিনগুলোকে, তবেই তো আমার প্রকৃত শিক্ষার যথার্থতা।”প্রতিশোধ নয়,কর্মের প্রতিফলনই হোলো জীবনের আসল কান্ডারী”।
মাত্র তেত্রিশ টাকা নিয়ে আমার ঢাকা আসার জীবন শুরু, কষ্টটা অনেকই, প্রকাশ করাটা একটা শব্দের বহিঃপ্রকাশ মাত্র,কিন্ত সেটা সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে চলা ও প্রতিশব্দের আঘাতটা তার থেকেও কয়েকগুন বেশি। “পকেটে একশো টাকার থেকে এক টাকা খরচা করা সেটা শিল্প বা আর্ট , কিন্তু নিরানব্বই টাকা খরচ করা সেটা গল্প বা ফাট”।
সাপ লুডোর খেলায় আমাকে আবার নিয়ে এলো “রাজ্জাক প্লাজার” সামনে। সেখানের দারোয়ান কে সমস্ত ঘটনাটা জানালাম আর আর্জি করি আঙ্কেল আমাকে একটা কাজ দিতে পারেন? যে কোনো কাজ হলে চলবে।উনি বলেন এভাবে তো চাকরি পাওয়া যায় না, আচ্ছা দেখা যাক আমি কি করতে পারি। আমি তখন খুবই পেঙলা ছিলাম।
যেটা পাই সেটাই করবো। রাজ্জাক প্লাজার পিছনে কমিশনারের মাঠে একজন দারোয়ানের প্রয়োজন ছিল, কারণ সেদিনের ডিউটিতে যে ছিল সে আসে নাই।আমাকে সাথে সাথে একটা হলুদ জামা পড়িয়ে দিল দারোয়ানের, কাজটা মাঠে।এটা ঠিক এনাম মেডিকেলের পেছনে, গ্রাম পাহারা দেওয়ার কাজ।সেই সময় সেই গ্রামে বেশ কিছু চোর ডাকাতের দলের উৎপাত ছিল, তাঁরা শহরে এসে ও উৎপাত চালাতো।
তখন প্রায় অনেক রাত আনুমানিক তিনটা হবে, দেখি তারা সামনে এসে আমার হাত পা বেঁধে ধান ক্ষেতে ফেলে দিল কিছু বোঝার আগেই।ওরা সারারাত ডাকাতি করে, পরের দিন অফিসার এসে জিজ্ঞাসা করে কাল রাতে এইখানে ডিউটিতে কে ছিল, আমাকে খোঁজে কিন্তু পাই না।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমাকে দেখে ও ধান ক্ষেত থেকে উদ্ধার করে আমার মুখে তারা রুমাল, ও হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।যাক কোনো ভাবে প্রাণটা বাঁচলো কিন্তু চাকরিটা রইলো না।আমার এখনো এগারো ক্লাসে ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি।আমি সাবার ছেড়ে ঢাকাই এলাম কোনো চাকরির সন্ধানে।
একদিন দেখি পেপারে একটা বিজ্ঞাপন একজন বৃদ্ধের দেখাশোনা ও তদারকি করার জন্য অল্প বয়সী একটা ছেলের প্রয়োজন জায়গাটার নাম ঢাকা শহরের মতিঝিল।বিজ্ঞাপন দেখে গেলাম, গিয়ে দেখি,লোকটি বেশ নাম করা, এক্ষুনি নামটা মনে পড়ছে না। তবে উনার লেখা বহু গদ্য ও কবিতা আমাদের ছোটোবেলার পাঠ্য ছিল।
উনার কাহিনীটাও অদ্ভুত বেশ কষ্টের ও উনি বললেন দেখো তোমরা হয়তো আমার লেখা পড়েছো আমার দুই ছেলে, কিন্ত তারা তাদের মত জীবন কাটাচ্ছে তাই এই বৃদ্ধ বয়সে আমার দেখাশুনা করার জন্য লোকের প্রয়োজন।
মনে ভাবলাম, হায় আল্লাহ ওনার সব আছে কিন্তু থেকেও নেই, আর যার চালচুলোও নেই সে হাতড়ে বেড়াচ্ছে একটু ভালো থাকার জন্য আর একটু পড়াশুনোর সুযোগ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য ।উনার প্রতি যে কাজটা ছিল সেটা হোলো সময় করে ওষুধ খাওয়ানো ব্যস এটাই, কিন্তু মন মানতো না একটা বন্দী দশা মনে হতো।একদিন কি একটা কাজে বের হয়েছি,কিন্তু বাসায় ফেরার রাস্তাটা চিনতে পারিনি।
আসলে দোষটা আমার আমি তো কলেজ খুঁজে বেড়াচ্ছি ইন্টারে ভর্তি হবো বলে। সেই ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেলি এসে পৌঁছলাম ঢাকার নিউ মার্কেট চত্বরে।পকেটে টাকা পয়সা নেই,খিদে পেয়েছে খুব ।কে দেবে টাকা, খিদে কেইই বা মেটাবে, তাই দুই তিন গ্লাস জল খেয়ে পেটকে শান্ত করলাম।
আমার সাথে পেটের যেন একটা কথা হয় খিদে পাওয়ার, পেটকে যেন বলি এখন পানি খেয়ে থাক টাকা রোজগার হলে খেতে দেবো।আল্লাহ রহমত সামনেই আমাকে একটা ভাতের হোটেল দেখালো, আমি সেখানে গিয়া ভাত চাইনি, ওটা পারিনা কারোর কাছে হাত পাততে,আর শরীর যখন নিজের মনের সাথে আপোস করতে পারে ।
আমি গিয়া বলি খালা আমাকে কিছু কাজ দিতে পারেন। খালা দেখি একটু সদয় হয়ে বললেন কাজ দিতে পারি এই হোটেলেই, তবে মাইনা সাতশো টাকা থাকা খাওয়া নিয়ে।রাজি হলাম কাজটা একটু পরিশ্রমের আর দায়িত্বের ।আমাকে ভাত ও সব্জি অফিসে অফিসে পৌঁছে দিতে হবে সময় মত, লেগে পড়লাম কাজে।
যেই খাওয়ার অন্যের জন্য পৌঁছচ্ছি সেটা যে নিজেরই খেতে ইচ্ছে করছে কি করি, আমার মুখ দেখে খালা আমাকে বললেন আগে খেয়ে নাও চটপট তারপর না হয় দিয়ে এসো।দেখলাম বেশ অনেক টিফিন বাক্স মাথায় করে নিয়ে যেতে হবে দোকানে দোকানে আবার সেগুলো খাওয়া হয়ে গেলে আনতে যাওয়া ও এসে ধুয়ে হোটেলের জায়গা মত গুছিয়ে রাখা।
এ কাজ আমি বেশিদিন করতে পারিনি প্রায় সতেরো আঠেরো দিন করেছি, তার একটাই কারণ একদিন সেই বাক্স নিয়ে চারতলায় উঠছি এমন সময় আমাকে একজন লোক ইচ্ছা করে বলবো না সেও হয়তো তাড়াহুড়োতে উঠছিলো, বোঝে নি আর আমাকে হাল্কা ঠেলা দিতেই সবশুদ্ধ নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যায়।খালা দেখেই তো আমাকে খুব বকাবকি করলেন, আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম দোষ টা যখন করেছি কি আর করার। রেগে গিয়ে যেটা হোলো আমার কাজটা দিল ছাড়িয়ে টাকাপয়সাও দিল না। পকেটে সর্বমোট খুব সম্ভব যতদূর মনে আছে সাত আট টাকা হবে।
ইতিমধ্যে নিউ মার্কেটের বাইরে একজন আমড়া বিক্রি করতো তার সাথে আসা যাওয়ার পথে পরিচয় হয় আমার, তাকে গিয়ে সমস্ত কথা বলি। চাকরি আর করবো না মনস্থ করি,তবে যদি এই আমড়া বিক্রি করার কাজটা করি আর সেও যদি উপকার করে কারণ একটাই টাকা পয়সা নেই যা বিক্রি হবে তারপর টাকা দিতে পারবো নচেৎ নয়।সে রাজি হোলো ও আমায় এইটুকু উপকার করলো।এদিকে সেরকম বিক্রি ও হয় না,এখনো মনে আছে পরপর তিনদিন খাওয়া জোটে নি।
পানি খেতাম আর কাজ করতাম। পেটে খাওয়ার না পড়লে একটা সময় পেট গোলাতো ও পেটে ব্যাথা হতো খুব,কিন্তু এটা কখনো কাউকে বলতাম না।মন বলতো কাজ করে পয়সা হলে তবেই খাবো পরের দিন সব কিছু দিয়ে থুয়ে দশটা টাকা এলো।
এখানে একটা তিনদিন না খেতে পাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলি সারাদিনের পর কাজ সেরে গেলাম হোটেলে খেতে। যেই ছেলেটা আমার ভাতের থালা এগিয়ে দিল টেবিলে এমন ছুঁড়ে দিল তাতে অল্প ডাল ও ভাত থালার থেকে বাইরে টেবিলে পড়লো। আমি কেউ না দেখে মত সেগুলো মুখে দিতেই মনে হোলো ভাত নয় মোতির টুকরা আমি গুছাইতেছি আর খাইতেছি উপলব্ধিটা কেমন সেটা আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না।
একজন অভূক্তই বোঝে ক্ষিদের জ্বালাটা কেমন আর তৃপ্তিটা কত মধুর। শেষ ভাতটা মুখে দেওয়ার আগে আল্লাহ কে বলি “হে আল্লাহ সবেরই অভিজ্ঞতা তো শিখাইলা অপেক্ষা শুধুই ভালো দিন দেখনের,এই কষ্টটা আর দিয়ো না বাঁচাইয়া রাখসো যখন কবরের পথটা যেন দেখতি না হয় তুমি সহায় আসো বাড়ি ছাড়ছি শিক্ষিত হবো বইলা-জীবনের উদ্দেশ্যে যেন ফসল ফলে, খরায় যেন মরতে না হয়”।এবার তো আমার থাকার জায়গাও নেই থাকবো কোথায়?আমড়া বিক্রির কাজ যখন করছি তখনের কথা ।
ঢাকার চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের নিচে বড় বড় টেবিল থাকতো ঐ টেবিলের উপর বুটিকের কাজ হতো সারাদিন ধরে, টেবিল গুলোতে লম্বা পর্দা দেওয়া থাকতো।
আমি সন্ধ্যের আগে টেবিলের নিচে ঢুকে থাকতাম,ঘুমোনোর একটা জায়গা ভেবে,কেউ যেন না বোঝে। দিন তিনেক কাটানোর পর একদিন ঐ শপিং মলের মালিক ভোরবেলায় আমাকে দেখতে পান উনি দারোয়ানকে ডেকে বকাবকি করাতে দারোয়ান আমায় লাঠির বাড়ি দিয়ে খেদিয়ে দিল আর বললো তোকে যেন এই এলাকার মধ্যে আর না দেখি।চলে এলাম আবারও নিউ মার্কেটে সেই আমড়া বিক্রির কাজে বন্ধুর কাছে।
তাকে গিয়ে সব ঘটনা বলি। তার সাথে বেশ পরিচয় হওয়াতে তাকেই প্রথম বলি বন্ধু খুব খিদা লেগেছে যদি পারিস তো কিছু আমাকে খাওয়া,আমড়া বিক্রি হলে তোর টাকা তোকে ফেরৎ দিয়ে দেবো। বন্ধু রাজি হোলো সে বললো তোকে টাকা দিতে হবে না তু্ই এক জায়গায় একটা জিনিস পৌঁছে দিলে তোকে বিশ টাকা দেবো, আমি তাতেও রাজি টাকা তো পাবো।
খেয়েদেয়ে সে আমায় কামরাঙ্গার চর বলে একটা জায়গায় জিনিস টা পৌঁছে দিতে বললো। দেখলাম একটা টোবলার মধ্যে কি জিনিস বুঝলাম না, সেখানে পৌঁছতেই দেখি একদল মেয়ে মানুষ বিড়ি খাচ্ছে, আমি গ্রামের লোক মেয়েমানুষকে কোনোদিন বিড়ি খেতে দেখিনি, মনে হোলো জায়গাটা খারাপ।
কিন্ত হাতে করে কি দিলাম সেটাও বুঝলাম না পণ করেছি আর কখনো টাকার লোভে এই কাজ করবো না। আমার মনে হয় কোনো ভালো কিছু নেই , হতে পারে সেটা মাদক জাতীয় জিনিস।ফিরে এলাম শুরু করলাম সেই আমড়া বেচার কাজ দুই তিনদিন কাজ করার পর পকেটে কিছু টাকা এলো নিজের খাওয়ার চালানোর সংকুলান হিসেবে।
ভাবলাম কাজটা তো ভালোই এইমুহূর্তে, তবে এখন আর বন্ধুর থেকে আমড়া না নিয়ে আমি গ্রামে গিয়ে আমড়া কিনে, ঢাকা শহরে এসে এগুলি বেচবো। তাই করলাম মন যেটা বললো। কিন্তু শহরে কোনো কাজ করতে গেলে তাদের সাহায্য নিয়ে করতে হবে সেটা জানা ছিল না, কারণ প্রত্যেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তাদের মতো করে চলতে হয় তাদের একটা সিন্ডিকেট আছে, তার বাইরে গেলেই বিপদ।
নিউ মার্কেটের সামনে প্রতিদিনের মত দাঁড়িয়ে আছি আমড়া নিয়ে, আমার আমড়া গুলো অনেক তাজা আর বিক্রিও ভালো হয়েছে সকাল থেকে, মনে ক্ষনিকের আনন্দ। দেখি এক চাচা কোথা থেকে এসে কিছু বোঝার আগেই আমার সবকটা আমড়া ফেলে দিল, সঙ্গে উপরি পাওনা গালাগাল আর চরথাপ্পড়।পরে বুঝলাম একটা ভিক্ষা করতে গেলেও আমাকে ঐ সিন্ডিকেটের মাধ্যম দিয়ে আসতে হবে নচেৎ সেটাও সম্ভব নয়।
মনের দুঃখে সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলেছি নিজেও জানি না,পরে দেখি ঐ কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছেছি যেখান থেকে আমার শহরের জীবন শুরু।কমলাপুরের কাছে টি এন টি মাঠের পাশে সারিবদ্ধ আবাসিক হোটেল, মনে ভাবলাম এই হোটেলের অভিজ্ঞতা তো আমার আগেই আছে দেখি কোনো কাজ পাই কিনা।টি এন টি মাঠের সামনে হোটেল “আলবেলা” সেখানে গিয়ে ম্যানেজারকে বলি।
ম্যানেজার আমায় বলে লেখাপড়া জানো, আমি বলি জানি, একটা গর্ব হোলো মনে যা জানি ওটাই আমার পুঁজি। ম্যানেজার আমায় একটা লেখা পড়তে দিলেন ইংরাজি ও বাংলাতে সেটাও পড়লাম। কিন্তু বললেন তুমি তো শিক্ষিত টাকা পয়সা তো বিশেষ একটা পাবে না।
আমি বলি স্যার টাকা লাগবে না থাকা খাওয়া দিলেই হবে, উনি রাজি হলেন।আমার একটা সমস্যা হোলো ইতিমধ্যে,সারা শরীরে একটা চুলকুনি শুরু হোলো। ম্যানেজার বলে তোমার তো সারাটা গা ফোলা ফোলা কোথাও মারধর খেয়ে এসেছো নাকি।
আমি বলি না, ঐ নিউ মার্কেট চত্বরে যেখানে কাঠের বাক্সের ভিতরে শুতাম সেখানে এতটাই মশা সারাটা রাত ধরে কামড়াতো,শরীরে মশারাও আর পারতো না তাই ফুলিয়ে দিত সারাটা শরীর। একথা বলাতে ম্যানেজার আমাকে ওষুধের দোকান থেকে কিছু ওষুধ দেয় পরে সেটা ঠিক হয়ে গেলো।
বাসার কথা মনে পড়তো মাঝে মধ্যে, আব্বা আম্মুর কথা সেটা রাতে শোবার সময়ে, সারাদিন হতো না -নিজের খিদে আর সংগ্রাম,আজ কি করবো কি হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই দিন পেরিয়ে যেত।বাসা ছাড়ার পর কোনোদিনই সে মুখো হই নি,ঐ যে লেখাপড়া করান নি।আমি আগে ওটা করবো তারপর একদিন শিক্ষিত হয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়াবো এটাই ছিল জীবনের সংকল্প।
কাজ করছি সারাদিন মন দিয়ে একদিন মালিক আমাকে ডেকে বলে তুমি খাওয়ার দাওয়ার করো না? আমি বলি টাকা নেই খাওয়ার কি ভাবে করবো আপনি মাস শেষ না হলে তো মাইনায় দেবেন না তাই ঐ কলা আর রুটি আছে মাঝে মধ্যেই খাই।শুনে মালিক কিছু অগ্রিম টাকা দিলেন। আমার একটা স্বভাব ছিল টাকা জমানোর রোজ রাতে সবাই শুয়ে পড়লে সেগুলো গুনতাম।
বেশ রাতের দিকে খেতাম তাহলে পরের দিন খিদে পেত না, ঠিক তারপরের দিন আবার খেতাম এটা একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো।প্রায় ছ টা মাস কেটে গেলো ঢাকায় দেখতে দেখতে।
সবাই দিনের বেলায় ডিউটি করে আমি ইচ্ছে করে রাতের ডিউটি নিতাম যাতে পরের দিন ঠিকঠাক ভাবে বের হতে পারি স্কুল বা কলেজে ভর্তি হওয়ার খোঁজে। কারণ মন বলছিলো এই জায়গাটাতে আমি কাজ করতে পারবো আগামী দিনগুলো,মালিক যেহেতু ভালো।ঘুরতে ঘুরতে ঢাকার “নটরডেম কলেজে” এসে পৌঁছলাম।
দেখি এই কলেজে অনেক কঠিন আইন শৃঙ্খলা এখানে আমার হবে না আমার যা কাজের জায়গা।তারপর সাধারণ কলেজ খুঁজতে বের হলাম ঢাকাতে বিজয়নগর, শান্তিনগর অনেক জায়গায় হেঁটে হেঁটে।যেদিকে দুচোখ যায়,শুধু হাঁটছি আর হাঁটছি। স্কুল ড্রেসে কাউকে দেখলেই তাদের পিছু নি,কে কোন স্কুলে পড়ে, সেখানে আমার ও যদি পড়ার স্থান হয়।একটা কলেজ পেলাম খবর নিলাম ভর্তি হতে হলে সেখানে সাতাশশো টাকা লাগবে,আমার কাছে অত টাকা নেই তাই আরো কষ্ট আর জমানোর মনোভাব এলো।
এদিকে হোটেলের টিপস চাওয়ার আদবকায়দা জেনে গেছি।যাই হোক চেষ্টাই আমি উনোত্রিশশো টাকা জোগাড় করে ফেললাম খুবই অল্প দিনের মধ্যে। এই টাকাগুলো আমি আমার হোটেলের এক ভাইয়ের কাছে রাখতাম,তাকে বিশ্বাস করতাম খুবই।ভর্তি কনফার্ম করলাম কর্তৃপক্ষের কাছে “ঢাকা কমার্শিয়াল কলেজ, ধানমুন্ডি” ফর্ম ও নিয়ে এলাম ভর্তির জন্য।মনে খুব আনন্দ আজ আমি কলেজে ভর্তি হবো।
হোটেলে এসে যেই ভায়ের কাছে টাকা রাখতাম তার কাছে গেলাম এই খুশির খবর টা দিতে। দেখি সেই ভাই আর নেই,সেদিনই সে হোটেলের চাকরি ছেড়ে টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেছে,কোথায় গেছে কেউ জানেনা। অনেক খুঁজলাম তাকে, প্রায় সপ্তাহ খানেক ঢাকা শহরে, পাওয়া গেলো না। ইচ্ছে আর কষ্ট নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম, হার মানলাম নিজের কাছে।
মনে ভাবলাম- “এই শহরে খুশির খবর শোনার কেউ নেই, যাঁরা অন্যের খুশিতে সামিল হন তারা অনেকটাই লোক দেখানো বরং অন্যের দুঃখে তারা ব্যথিত দেখালেও আদতে তারা খুশি হন মন থেকে, দুনিয়াটা পুরাটাই উল্টা”।
লালনের পরবর্তী অধ্যায়ে আসছি সে কতটা শিখরে উঠেছে এখন যা আমাদের ধারণার ও বাইরে, তার আগে আরো শেষ কিছু সংগ্রাম বাকি আছে বালক লালন থেকে অন্যের পালনকর্তা হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সচেষ্ট প্রয়াসের কাহিনীতে।
ক্রমশঃ…….